সোমবার, মে ১৩, ২০২৪

নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল

আর ও খবর

তরুণ প্রজন্মের জন্য আর্শীবাদ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ

মোঃ তৌহিদুজ্জামান : মাত্র দুই দশক আগেও অধিক জনসংখ্যা আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচিত ছিল। আজ সেই জনসংখ্যাই আমাদের সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সাম্প্রতীক সময়ে বিশ্বের অনেক নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের পূর্বাভাস দিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মানবসম্পদকে যে বিবেচনায় নিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতিক লভ্যাংশে অবস্থান করছে। ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই স্বর্ণসময় ২০৩৮ সাল পর্যন্ত অব্যহত থাকার পূর্বভাস রয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৬৮ শতাংশই কর্মক্ষম। আর এই কর্মক্ষম মানুষগুলোর অধিকাংশই তরুণ। প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ আমাদের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে দক্ষ জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে যা আমাদের সামনে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

এতসব ইতিবাচক দিক এবং সম্ভাবনা থাকা সত্বেও দক্ষতা উন্নয়নে ঘাটতির কারণে এ বিশাল সম্ভাবনাকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে সক্ষম হইনি। এখনও আমাদের শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশই সাধারণ বিষয়ে লেখাপড়া করছে। সাধারণ শিক্ষা নিয়ে এসব তরুণ একদিকে কাজ পাচ্ছে না, অন্যদিকে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কয়েক লক্ষ বিদেশী দক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। প্রবাস থেকে আমাদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অদক্ষ শ্রমিকরা কারিগরী জ্ঞানের অভাবে দেশে ফিরে আসছে। স্বল্প দক্ষরা কম মজুরীর কাজে নিয়োজিত থাকছে। অনেকে বাংলাদেশের মান অনুসারে দক্ষতা অর্জন করেছে কিন্তু তা গন্তব্য দেশের মানের সমপর্যায় না হওয়ায় তারাও কম মজুরী পাচ্ছে। প্রবাসে আমাদের কাছাকাছি অনেক দেশের শ্রমিক আমাদের তুলনায় বেশি মজুরী পাচ্ছে।

এমন বাস্তবতা সত্বেও নিম্ন আয়ের দেশ থেকে আমাদের মধ্য আয়ের দেশে পদার্পণ বা অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে দক্ষতা উন্নয়ন প্রচেষ্টার ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ প্রচেষ্টায় আমাদের অনেক অদক্ষ শ্রমিক স্বল্প দক্ষ হয়েছে, স্বল্প দক্ষরা আধা-দক্ষ এবং আধা-দক্ষরা দক্ষ শ্রমিকে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম বা প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কারিগরী প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নানা ঘাটতির কারণে দক্ষতা উন্নয়নে কাঙ্খিত সাফল্য আসেনি। প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং বা তত্বাবধানে ঘাটতি রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের মান বজায় নেই । প্রশিক্ষণার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া সনদ দেওয়ায় সেই সনদ নিয়ে শ্রমিকরা দেশে-বিদেশে কাজ পাচ্ছে না। অনেকে দেশের মান বজায় রেখে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কিন্তু তা গন্তব্য দেশের মান অর্জন করছে না। আবার কিছু শ্রমিক আছে যারা কাজে দক্ষ কিন্তু তাদের সনদ নেই। তারাও মজুরী, পদোন্নোতিতে বঞ্চিত হচ্ছে।

এসব বাস্তবতায় সকল দক্ষতা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধন ও প্রশিক্ষণ ঘাটতি কমিয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা সম্পন্ন ও সম্ভাবনাময় পেশায় দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা এনএসডিএ। এ কর্তৃপক্ষে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে- ১.জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি, কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, ২) সরকারি-বেসরকারী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন প্রশিক্ষণ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ণ, ৩) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার পূর্বাভাস সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ ও খাতভিত্তিক দক্ষতা তথ্যভান্ডার প্রতিষ্ঠা করা, ৪) দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল প্রকল্প ও কর্মসূচি পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় সাধন, প্রশিক্ষণ মান উন্নয়ন, সনদায়ন ও পারস্পরিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা, ৫) শিল্প দক্ষতা পরিষদ গঠন করে শিল্প সংযুক্তি শক্তিশালী করা ৬) সকল দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করা, ৭) দক্ষতা কার্যক্রমের প্রচার প্রসারের মাধ্যমে যুব সমাজকে দক্ষতা প্রশিক্ষণে সম্পৃক্ত করা ইত্যাদি।

এনএসডিএ’র এসব কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ৩৩৪ টি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন প্রদান করা হয়েছে। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোকে সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক কোর্সের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, দুই সহস্রাধিক শ্রমিককে দক্ষতা সনদ প্রদান করা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসেসর ও প্রশিক্ষক পুলভূক্ত হয়েছে। কর্মসংস্থানের চাহিদা ও যোগানের রিয়েল টাইম ডাটা, গ্রাজুয়েট ট্র্যাকিংসহ অনলাইন নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ মূল্যায়ন, প্রশিক্ষণার্থীদের অ্যাসেসমেন্ট ও সনদায়নের সুযোগসহ ১৬টি মডিউল সম্বলিত ন্যাশনাল স্কিলস পোর্টাল (ংশরষষংঢ়ড়ৎঃধষ.মড়া.নফ) ইতিমধ্যে লাইভে এসেছে। এ পোর্টালে নিবন্ধন ও সনদায়ন হতে সকল প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের একটি সমন্বিত ডাটাবেজে শিল্প সংগঠনসমূহের অন্তর্ভুক্তি থাকবে। এতে শিল্প তার প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি পোর্টালের মাধ্যমে সংগ্রহ করে নিতে পারবে। এ পোর্টলে নিবন্ধন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী একজন ব্যক্তিরও নির্ধারিত ফিস দিয়ে তার জন্য উপযোগি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণগ্রহন, প্রশিক্ষণ মূল্যায়ন ও সনদ প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেকে আছেন দক্ষ কিন্তু সনদ নেই তারাও নিবন্ধনের মাধ্যমে মাত্র তিনদিনের প্রক্রিয়ায় সনদ পেতে পারেন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সমন্বিত দক্ষতার মানদণ্ড আমাদের জাতীয় যোগ্যতা কাঠামোতে দক্ষতার যে ১০টি স্তর আছে তার ১-৬ অর্থাৎ মৌলিক যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী, স্বল্প দক্ষ কর্মী, দক্ষ কর্মী, উচ্চতর দক্ষ কর্মী, তত্ত্বাবধায়ক এবং মধ্যম স্তরের ব্যবস্থাপক/উপসহকারী প্রকৌশলীর প্রশিক্ষণ ও সনদায়ন প্রক্রিয়ার সার্বিক বিষয়গুলো সমন্বয় করছে এনএসডিএ। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গন্তব্য দেশের দক্ষতা মানের যে পার্থক্য আছে তা দূর করতেও কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধির পূর্বশর্ত তার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। উৎপাদনশীলতা বাড়ে দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে। গুনগত দক্ষতা প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করাই জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মূল লক্ষ্য। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও দেশে-বিদেশে গ্রহনযোগ্য সনদায়নে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য নিঃসন্ধেয়ে এক বিরাট আর্শীবাদ। লেখক :-উপপ্রধান তথ্য অফিসার
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রাজশাহী।

পিআইডি, রাজশাহী

সর্বাধিক পঠিত