সোমবার, মে ২০, ২০২৪

নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল

আর ও খবর

প্লট-পুকুরের পেটে যাচ্ছে কৃষিজমি

স্টাফ রিপোর্টার: প্রতিবছর মাছ উৎপাদন বাড়ছে রাজশাহীতে। বাহবা পাচ্ছে মৎস্য বিভাগ, কিন্তু মাছ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে আবাদী জমি। আবার একরের পর একর কৃষিজমিতে করা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। প্লট করে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে এগুলো। ফলে কৃষিজমি কমছে। প্রধানমন্ত্রী কৃষিজমি রক্ষার যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা রাজশাহীতে উপেক্ষিত।

প্রায় এক যুগ আগে রাজশাহীতে পুকুর খননের হিড়িক পড়ে যায়। জেলার পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, চারঘাট, বাঘা ও বাগমারা উপজেলার মাঠে মাঠে পুকুর কাটা হয়েছে তিনফসলি জমিতে। আকাশপথে যারা রাজশাহী-যাওয়া আসা করেন এসব এলাকায় ওপর থেকে তাদের চোখে পড়ে শুধু পুকুর আর পুকুর। অবৈধভাবে পুকুর খননের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চললেও পুকুর কাটা কোনভাবেই ঠেকানো যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ-প্রশাসন আর এক শ্রেণির সাংবাদিকদের ‘ম্যানেজ’ করেও পুকুর খনন করা হয়েছে। পুকুর কাটতে চলেছে লাখ লাখ টাকার খেলা।

মৎস্য বিভাগের হিসাবে, ২০১৭ সালেও জেলায় বাণিজ্যিক মাছের খামার ছিল ৩ হাজার ৪৬২ হেক্টর জমিতে। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ১২ হাজার ৩০৯ হেক্টর। ২০২২ সালে হয় ২৫ হাজার ৩০৯ হেক্টর। জেলায় এখন বাণিজ্যিক মাছের খামারের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। এই পাঁচ বছরেই প্রায় ২২ হাজার হেক্টর আবাদী জমি গেছে পুকুরের পেটে। যত্রতত্র পুকুর খননের কারণে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফসলের আবাদও কমে গেছে।

তবে পুকুর খননের কারণে আবাদী জমি কমলেও তাতে সমস্যা দেখেন না জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘কৃষির চারটি বিভাগ রয়েছে। ফসল উৎপাদন, বনায়ন এবং প্রাণিসম্পদের মতো মৎস্যও কৃষির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, পুকুরের কারণে জমি কমে যাচ্ছে তা বলা যাবে না। দেশে মাছেরও উৎপাদন প্রয়োজন। পুকুর হলে তো সমস্যা নেই।’

তাঁর এ বক্তব্যের দ্বিমত জানিয়ে গবেষক ও উন্নয়নকর্মী পাভেল পার্থ বলেন, ‘মানুষ কি তাহলে শুধু মাছই খাবে? তিনফসলি জমিতে তো অন্য ফসলও করা যেত। আমাদের দুধ-ডিম, ভাতও খেতে হবে। এখন মাছ ছাড়া কিছুই হবে না। আইনে আছে কোনভাবেই কৃষিজমির বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা যাবে না। কিন্তু পুকুর কেটে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। তাই মৎস্য কৃষির অন্তর্ভুক্ত হলেও কৃষিজমিতে খামার করা যাবে না। এ জন্য দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি ঘেরের ক্ষেত্রে আইন আছে। কোন জমিতে ঘের হবে তা উল্লেখ আছে। বরেন্দ্র অঞ্চলেও কোথায় পুকুর হবে তার জন্য আইন দরকার। কোথায় কী উৎপাদন হবে সেই জোনিং করতে হবে।’

এদিকে রাজশাহী শহর সংলগ্ন গ্রামগুলোতে এখন কৃষিজমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসন প্রকল্প। কৃষকের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়ে প্লট আকারে তা বিক্রি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোন নিয়ম-নীতিরই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। নগরীর সিটিহাট এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি কেনা শুরু করেছে আমানা গ্রুপ। এখানে আমানা উত্তরায়ন সিটি করার সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ধানখেতের ভেতর লাগানো হয়েছে সাইনবোর্ডগুলো।

শহরের পশ্চিমপ্রান্তে পবা উপজেলার দামকুড়া ইউনিয়ন। দামকুড়ার মধুপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ফসলি জমিতে সীমানা প্রাচীর দিয়ে প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা কাঠা হিসাবে। মধুপুরে মাজদার সরকার নামের এক ব্যক্তির ১০ বিঘা কৃষিজমি কিনে একটি আবাসন প্রকল্প করেছেন মো. জাহাঙ্গীর, মো. মন্টু, মো. জাহাঙ্গীর ও মো. রফি নামের চার ব্যক্তি। এ রকম প্রকল্প করতে কয়েকটি সরকারী দপ্তরের অনুমোদন লাগলেও তারা কিছুই নেননি। বিষয়টি স্বীকার করে মো. রফি বলেন, ‘এ এলাকায় অনেক প্রকল্প হচ্ছে। কারও অনুমোদন নেই, আমাদেরও নেই। এভাবেই প্রকল্প হচ্ছে।’

অভিযোগ পাওয়া গেছে, আবাসন ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে জোর করেও জমি কিনছেন। গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদীঘি এলাকায় এ রকম সমস্যায় পড়েছেন মাসুদ রানা সনি। তিনি জানান, বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার রেখে যাওয়া জমি আকড়ে ধরে আছেন। চাষবাস করে সংসার চালান। আশপাশের কৃষকেরা আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছে জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাকেও বিক্রি করতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। জমিতে ফসল করতে দেয়া হচ্ছে না।

এদিকে রাজশাহীতে তেমন শিল্প-কারখানা হয়নি। তবে নতুন নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণের কারণেও কৃষিজমি কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কৃষি শুমারি-২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে রাজশাহীতে খানার সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫টি। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৮৮৮টি। এক দশকে খানা বেড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫২৩টি।

রাজশাহীতে ২০০৮ সালে চাষাবাদ হতো ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমি। ২০১৯ সালে তা কমে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৩৩ হেক্টরে নেমেছে। অর্থাৎ এক দশকেই ১০ হাজার ২২৬ হেক্টর কৃষিজমি কমেছে। ২০০৮ সালে আবাদী জমির আয়তনের পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা কমে ৬৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ হয়েছে। নতুন নতুন বসতবাড়ি নির্মাণ ছাড়াও পুকুর খননের কারণে রাজশাহীর কৃষিজমি কমে গেছে।

প্রতিদিনই কৃষিজমি কমে গেলেও তা রক্ষায় নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলছে কৃষি বিভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘কৃষিজমিতে কোথাও প্লট হলে কিংবা পুকুর কাটা হলে আমরা গিয়ে সরাসরি বাধা দিতে পারি না। এ জন্য শক্ত কোন আইন নেই। কৃষিজমি কমে যাচ্ছে দেখে আমরা প্রায়ই স্থানীয় প্রশাসনকে জানাই। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলি। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।’

জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধভাবে তিনফসলি জমিতে পুকুর খনন দেখলেই আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়। তারপরও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পুকুর খনন করা হয়। আর যে কোন স্থানেই আবাসন প্রকল্প করতে হলে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন লাগে। কেউ অনুমোদন না নিয়ে করলে আমরা ব্যবস্থা নেব। যদি প্লট আকারে জমি বিক্রির আবেদন আসে, তখন আমরা দেখি জমিটিতে বছরে কয়টা ফসল হচ্ছে। আমরাও কৃষিজমি নষ্ট করতে দেই না। এক্ষেত্রে কৃষিজমি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা আমরা সেটিই বাস্তবায়ন করি।’

সর্বাধিক পঠিত