বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল

আর ও খবর

আশুরা ও কারবালার সঠিক ইতিহাস

ওমর ফারুক কুতুবী : ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার ৩ বছরের শাসনামলে তিনটি ন্যাককার জনক ঘটনার সাক্ষী হয় ইতিহাস। প্রথমটি কারবালায় নবী দৌহিত্র হোসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত। দ্বিতীয়টি মদিনায় আক্রমণ যা ‘হাররার যুদ্ধ’ নামে ইতিহাসে সমধিক প্রসিদ্ধ। তৃতীয়টি পবিত্র কা’বায় অগ্নিসংযোগ।

ইসলামী খেলাফতের ইতিহাসে সর্বাধিক বিচক্ষণ ও রাজ্য বিজেতা শাসকদের অন্যতম হলেন মুয়াবিয়া (রাঃ)। তাঁর শাসনামলে ইসলামী খেলাফতের সীমানা যেমন বহুদূর বিস্তৃত হয় তেমনি সকল অঞ্চলের বিদ্রোহীদের দমনেও তিনি সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দেন। ৬০ হিজরী সনের ১৫ মতান্তরে ২২শে রজব তাঁর ইন্তেকালের পর মুসলিম জাহানের শাসক হন তদীয় পুত্র ইয়াজিদ। সে ৩ বছর ৬ মাস শাসনকার্য পরিচালনার পর বিরল

রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩৬/৩৮ বছর বয়সে ৬৪ হিজরির ১৪ই রবিউল আউয়াল তারিখে মৃত্যুবরণ করে।

খেলাফতের আসনে আসীন হওয়ার পূর্বে একজন সাহিত্যামোদী, কবি, বিনয়ী এবং বীরপুরুষ হিসেবে ইয়াজীদের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। এমনকি সাইয়িদুনা হোসাইন (রাঃ) সহ বহু সংখ্যক সাহাবী, তাবেঈ ইয়াজিদের সেনাপতিত্বে কনস্টান্টিনোপলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আলেমদের মজলিসেও তার যাতায়াত ছিল। যেমনটি সহীহুল বুখারী-৬৪১১এর বর্ণনায় সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) এর মজলিসে তার উপস্থিতির আলোচনা স্থান পেয়েছে। কিন্তু খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে তার বিরুদ্ধে কুকুর-বানর পালন, মাদকাসক্তি, নামাজে অলসতার মত নানাবিধ মন্দ অভ্যাসে আসক্তির অভিযোগ ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে স্থান পেয়েছে।

তবে তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলকে সবচেয়ে কলঙ্কিত করেছে যে তিনটি ঘটনা তার প্রথমটি হলো জান্নাতী যুবকদের সরদার হোসাইন বিন আলী রাঃ)’র শাহাদাত। কারবালার ঘটনা প্রবাহঃ মুয়াবিয়া (রাঃ)’র শাসনের শেষ পর্যায়ে মুসলিম বিশ্বের সকল অঞ্চলে ইয়াজিদের হাতে বায়াত সম্পন্ন হলেও পাঁচ জন শীর্ষস্থানীয় সাহাবী তার হাতে বায়াত হতে দূরে থাকেন। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বীরপুরুষ এবং বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। ইলম, আমল, তাকওয়া-পরহেজগারি, বংশ গৌরব ও সম্মান মর্যাদায় প্রত্যেকেই ইয়াজিদ থেকে বহু গুণে অগ্রগণ্য ও শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তবে সহীহুল বুখারীর ৭১১১ নম্বর হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)ও বিশেষ বিবেচনায় ইয়াজিদের বাইয়াত মেনে নিয়েছেন মর্মে বর্ণনা রয়েছে।

হোসাইন (রাঃ) ইয়াজিদের বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করেছেন মর্মে অবগত হয়ে ইরাকের কুফা নগরীর অধিবাসীগণ শত শত পত্র লিখে তাঁর হাতে বাইয়াত হবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে কুফায় আমন্ত্রণ জানান। পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য হোসাইন (রাঃ) চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকীলকে সেখানে প্রেরণ করেন। তিনি কুফা বাসীর প্রতিশ্রুতি পেয়ে পরিস্থিতি অনুকূল বলে হোসাইন (রাঃ) এর নিকট পত্র লিখলে তিনি কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ সময় শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর কুফায় গমনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাঁকে তা থেকে নিবৃত রাখার চেষ্টা করেন। বিশেষত কুফাতেই তাঁর পিতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রাঃ) অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়ে শহীদ হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করেন। কিন্ত হোসাইন (রাঃ) তাঁর ইজতিহাদের উপর অনঢ় থাকেন এবং কোন ধরনের যুদ্ধ প্রস্তুতি, যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধের রসদ ব্যতীত পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের একটি কাফেলা নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।

পথিমধ্যে দূত মারফত অবগত হলেন যে তাঁকে সমর্থনকারীরা গা ঢাকা দিয়েছে এবং মুসলিম ইবনে আকীল নিহত হয়েছেন। এমন সংবাদে অত্যন্ত মর্মাহত হলেও তিনি তাঁর যাত্রা অব্যাহত রাখেন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে উপনীত হলে ইয়াজিদের অধীন কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের বাহিনী তাঁর কাফেলার গতিরোধ করে এবং তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় হোসাইন (রাঃ) তাদেরকে তিনটি প্রস্তাব পেশ করে এর যেকোনো একটি মেনে নেওয়ার অনুরোধ জানায়। প্রস্তাবগুলো হলো ১.তাঁকে ইয়াজিদের কাছে যেতে দেয়া হোক ২.তাঁকে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক ৩.তাঁর পথ ছেড়ে দেওয়া হোক, তিনি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থান করে ইসলামের জন্য জিহাদ করে বাকী জীবন অতিবাহিত করবেন। কিন্তু হঠকারীরা তাঁর কোন প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি বরং তাঁকে ইয়াজিদের বাইয়াত মেনে নেয়া অথবা অস্ত্র ধারণ এ দুটির যেকোনটি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রাখে। ফলে তিনি এবং তাঁর সঙ্গীগণ নিরুপায় হয়ে আত্মরক্ষার্থে নিজেদের সাথে থাকা কোষবদ্ধ তরবারি নিয়েই প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হন এবং বীরত্বের সাথে লড়াই চালিয়ে যান। সে লড়াইয়ে নবী পরিবারের অনেক সদস্য এবং হোসাইন (রাঃ) এর শুভাকাঙ্ক্ষী সহ সর্বমোট ৭২ জন শাহাদাত বরণ করেন।

প্রত্যেক মুসলিমই নিজ অন্তরে আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের সদস্যদের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা লালন করেন। হোসাইন (রাঃ) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের এ মর্মান্তিক মৃত্যু কোন যুগেই মুসলিমগণ স্বাভাবিক মেনে নিতে পারেননি। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাটি সংঘটিত হয় ৬১ হিজরনের ১০ই মুহাররম আশুরার দিন। ইসলামে বহু পর্ব থেকেই আশুরা বছরের উল্লেখযোগ্য একটি দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা তাতে নতুন মাত্রা যোগ করল। আশুরার দুটি দিক রয়েছে। একটি ফজিলত, অপরটি ইতিহাস। আশুরার ফজিলত স্বয়ং নবীজি (সাঃ) নিজেই ঘোষণা করেছেন। তাই তাঁর ইন্তেকালের ৬০ বছর পরে সংঘটিত কারবালার ঘটনার কারণে আশুরার ফজিলতের কোন বৃদ্ধি বা ঘাটতির সম্পর্ক নেই। তবে পৃথিবীর সূচনা থেকে আশুরার যে ঐতিহাসিক মর্যাদা রয়েছে সন্দেহাতীত ভাবে কারবালার ঘটনা তাতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। আমাদের দেশে কতিপয় মুসলিম আশুরার ফজিলত বলতে কারবালার ঘটনাটাকেই বুঝে থাকেন, যা মোটেও সঠিক নয়। বরং সহীহুল বুখারীর ৩৩৯৭ নম্বর হাদিসে স্থান পেয়েছে যে, আশুরার দিনেই নবী মুসা (আঃ) অত্যাচারী মিসরীয় শাসক ফেরাউন এবং তার বাহিনী থেকে মুক্তি পান এবং ফেরাউন তার দলবল সহ লোহিত সাগরে ডুবে শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করে। এর শুকরিয়া স্বরূপ তিনি পরবর্তী আশুরার দিনগুলোতে রোজা রেখেছিলেন। সে থেকে ইহুদীরা প্রতিবছর আশুরার দিনে সিয়াম পালন করে থাকে। এছাড়া সহিহুল বুখারীর ৪৫০৪ নম্বর হাদিসে আরো উল্লেখিত হয়েছে জাহেলী যুগে মক্কার কুরাইশরাও আশুরার সিয়াম পালন করত। এবং মদিনায় হিজরতের পরে আশুরার সিয়াম ফরজ রুপেও পালন করা হয়। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল বলে গণ্য হয়।

বিশ্বব্যাপী শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতি আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিল বের করে এবং নানান ভাবে কারবালার ঘটনা স্মরণ করে শোক পালন করে থাকে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং জঘন্য অপরাধ বিবেচিত। নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুতে তিন দিন, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদে তিন মাস এবং স্বামীর মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৪ মাস ১০ দিন শোক পালনের বিধান ইসলামে রয়েছে। এ ছাড়া বছর বছর শোক পালনের কোন নিয়ম ইসলামে স্বীকৃত নয়। তাছাড়া নবীজি (সাঃ) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি শোক প্রকাশ করতে গিয়ে গালে আঘাত করে, পরিধেয় বস্ত্র ছিঁড়ে ফেলে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়” বুখারী-১২৯৪। তাই আমাদের উচিত, নবীজি (সাঃ) এবং আহলে বাইতের প্রতি যথাযোগ্য ভালবাসা, সম্মান ও মর্যাদা পোষণ করা। পাশাপাশি কুরআন-সুন্নায় নিষিদ্ধ যাবতীয় অজ্ঞতা প্রসূত কাজ থেকে বিরত থাকা।

 

একটি বিশেষ অনুরোধ, কারবালার ইতিহাস এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি জানতে অনির্ভরযোগ্য উৎস বর্জন করা একান্ত কর্তব্য। এক্ষেত্রে ইমাম ইবনে কাসীর প্রণীত এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত আল ‘বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ নামক ইতিহাস গ্রন্থটি (অষ্টম খন্ড) ভালো একটি উৎস হতে পারে।

লেখক: ইমাম ও খতিব বাংলাদেশ সচিবালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, ঢাকা।

পিআইডি ফিচার

সর্বাধিক পঠিত

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com