স্টাফ রিপোর্টার: বৃষ্টির ওপর ভরসা করেই আমন ধানের চাষ শুরু করেন বরেন্দ্র এলাকার কৃষকেরা। কিন্তু এ বছর বর্ষাকাল শেষ হতে চললেও বৃষ্টির তেমন দেখা নেই। ফলে আমন ধানের আবাদে নেমে চাষিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাধ্য হয়ে চাষিদের বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ থেকে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে আমন ধান বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে।
কিন্তু গভীর নলকূপ থেকেও সময়মতো পানি পাচ্ছেন না চাষিরা। দিনের পর দিন সেচের পানির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আর বর্ষার খরতাপে আমনের খেত ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। চাষিরা বলছেন, আমন ধানের ফলন বোরোর চেয়ে অনেক কম। তাই বৃষ্টির পানিতে এ ধান চাষ করা হয় যেন উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বৃষ্টি না হওয়ায় বাড়তি খরচ করে ভুগর্ভস্থ পানি কিনে আমনের খেতে সেচ দিতে হচ্ছে তাদের।
এ অবস্থায় অনেক কৃষক এবার এখনও আমন ধানের আবাদেই নামেননি। আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, জুলাইয়ের শেষদিন পর্যন্ত রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ জমিতে আমনের আবাদ শুরু হয়েছে। নাটোর ও নওগাঁয় আবাদ হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ জমিতে। কৃষি বিভাগ বলছে, সাধারণত পাট কেটে নেওয়ার পর চাষিরা আমনের আবাদ শুরু করেন। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে পাট জাগ দেওয়ার সমস্যার কারণে চাষিরা পাট কাটতে দেরি করছেন। ফলে আমন আবাদ বিলম্বিত হচ্ছে। আবার বৃষ্টি না থাকার কারণে অনেকে আমনের আবাদে নামছেন না। ফলে আবাদ এখনও কম রয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে আমন চাষের জন্য রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৪ লাখ ৫ হাজার ৯ হেক্টর জমি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এই পরিমাণ জমিতে ধান চাষ হলে ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৮৮ মেট্রিক টন উৎপাদনের সম্ভাবনা ধরা হয়েছে। তবে বৃষ্টিহীনতার কারণে চাষ এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কতটা পূরণ হবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক জমিতে ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। শুধু বৃষ্টির ওপর নির্ভর করেই এসব জমিতে আমন চাষ হয়ে থাকে। এবার তা হচ্ছে না।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার উদপুর মাঠের চাষি কবির হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই মাঠটা অনেক উঁচু। এখানে বিএমডিএর গভীর নলকূপও নেই। বছরে শুধু আমন ধানটাই হয় বৃষ্টির পানিতে। এবার বৃষ্টিপাত না থাকার কারণে এই মাঠে চাষাবাদই শুরু করা যায়নি।’
তানোরের গৌরাঙ্গপুর গ্রামের চাষি দুলাল হোসেন বলেন, ‘আমরা বৃষ্টির পানি দিয়েই এই আমন ধানটা করি। কিন্তু এবার বৃষ্টি নাই। ধান লাগিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছি। বাধ্য হয়ে ডিপ থেকে পানি কিনতে হচ্ছে। তা-ও সিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচদিন পর পানি দরকার, পাচ্ছি ১০ দিন পর। পানি দেওয়ার তিন দিন পর থেকেই জমি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।’
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার মেলান্দহ গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বীজতলায় আমনের চারা করেছি। চারা বড় হয়ে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে এখনও রোপণ করতে পারছি না। এদিকে আষাঢ় শেষ হয়ে গেছে, শ্রাবণও শেষের পথে। বৃষ্টি হচ্ছেই না। এখন ডিপ থেকে পানি কিনে এই আবাদ করলে তো লাভ হবে না। কারণ, আমনের ফলন কম হয়।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল বলেন, দেশে গড় বৃষ্টিপাত যেখানে আড়াই হাজার মিলিমিটার, সেখানে বরেন্দ্র অঞ্চলে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটারের বেশি হয় না। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় এমনিতেই বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম, এবার তা আরও কমে গেছে। ফলে বর্ষাকালেও খরা কাটছে না।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার বর্ষা মৌসুমে এখন পর্যন্ত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং নাটোরে গড়ে ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গত জুলাইয়ে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কখনও কখনও আকাশ মেঘলা হচ্ছে, কিন্তু তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না। বৃষ্টি হলেও তা পরিমাণে কম।
আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘বৃষ্টি কমে গেলে সমস্যা তো হবেই। এতে চাষাবাদ বিঘ্ন হচ্ছে। তবে আমনকেও এখন বৃষ্টিনির্ভর চাষাবাদ বলা যাবে না। কারণ, কয়েকবছর ধরে এই ধানেও ভূগর্ভস্থ পানি দিতে হচ্ছে। চলনবিলের পেটেও এখন ভূগর্ভস্থ পানি তুলে আমনে সেচ দিতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে আমন রোপণের সময় হিসেবে ধরা হয়। সে হিসেবে সময় এখনও আছে। এর মধ্যে আরও জমিতে আমন চাষ হবে। উৎপাদনে সমস্যা হবে না।’