অনলাইন ডেস্ক : পটুয়াখালীর দুমকির আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রামের ১০টি বাড়ির সাতটিতেই এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব বাড়ির ৩৭টি পাত্রের ১০টিতেই মিলেছে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এ মশার লার্ভা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ২৩ জুলাই ওই জরিপ চারায়। এর সপ্তাহ দুয়েক আগে ১১ জুলাই আরেক জরিপে পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়িনের ১০টি বাড়িতে গিয়ে সাতটিতে এইডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এগুলোর ১৬টি পাত্রের মধ্যে আটটিতে লার্ভা ছিল।
এ বছর দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিস্তারের মধ্যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় এইডিস মশার এমন উপস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
জুলাই থেকে অগাস্ট পর্যন্ত করা এ জরিপে গ্রামেও যে পরিমাণ লার্ভা শনাক্তের তথ্য মিলেছে সেটিকে উদ্বেগজনক বলছেন তারা। আগে মশাবাহী এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঢাকায় এবং বিভিন্ন নগরীতে বেশি ছড়ালেও এখন দেশজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ ডেঙ্গু শনাক্ত ও রোগী ভর্তির তথ্যও সেটির সাফাই দিচ্ছে। এ বছর শুরুতে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তির সংখ্যা বেশি থাকলেও ক্রমে এ চিত্র বদলাতে থাকে। গত কয়েকমাস থেকে ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে এসে পরিস্থিতি উল্টে যায়।
২০ জুলাই সারাদেশে ১৭৫৫ জন রোগী ভর্তি হয়। সেদিন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ৯১০ জন এবং ঢাকায় ৮৪৫ জন রোগী ভর্তি হয়। এর পর থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ছাড়া বাকি সময় ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে।
১৪ অগাস্ট মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যায় ঢাকাকে ছাড়িয়ে যায় বাইরের জেলাগুলো।
সেদিন পর্যন্ত সারাদেশে ৮৭ হাজার ৮৯১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, যার মধ্যে ঢাকায় ৪৩ হাজার ৬৬৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৩ দশ হাজার ২২৬ জন।
সবশেষ রোববার সকাল পর্যন্ত এক দিনে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসময়ে আরও ২৩২৭ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; যাদের মধ্যে ৯২০ জন ঢাকায় এবং ১৪০৭ জন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়।
এ নিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫১১ জনে। এখন পর্যন্ত ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৪০৯ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে তা ৬০ হাজার ১০২ জন।
হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং মৃত্যুর এ সংখ্যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আশঙ্কা।
এমন পরিস্থিতি ভালো ঠেকছে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের কাছে।
দেশজুড়ে ডেঙ্গু নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার অবজারভেশন বলে লক্ষণ ভালো না। সব জায়গায় এইডিস মশা আছে। এটা সামনে আমাদের খারাপ সময় নিয়ে আসছে। ডেঙ্গু সারাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
“এখনও শহরেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না যেখানে অনেক লোকবল, ফান্ড আছে। ইউনিয়ন পরিষদ বা গ্রামে ঢুকে গেলে কে নিয়ন্ত্রণ করবে, গ্রামের মানুষকে কে সচেতন করবে?”
অন্য বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকরাও বলছেন, ঢাকার বাইরে রোগী এভাবে বাড়তে থাকলে চিকিৎসা ব্যবস্থায় চাপ বাড়বে।
কী বলছে জরিপ
মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা এর বেশিতে যদি এইডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়। আর হাউজ ইনডেক্স পাঁচের বেশি হলে তাকে মশার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বিবেচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
গত জুলাই ও অগাস্টে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, যশোর, পিরোজপুর ও পটুয়াখালীর কয়েকটি এলাকায় জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে সবগুলো এলাকাতেই মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী উচ্চ ঝুঁকিতে
গত ২৩ থেকে ২৮ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টিতে জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপে ১০৫০টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১৫০টিতে এবং জরিপ করা ১০২৪টি পাত্রের মধ্যে ২৫৩টিতে মেলে এইডিসের লার্ভা।
এ জরিপে ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৪টিতেই মশার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। সবচেয়ে বেশি ৮৭ পাওয়া যায় ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে।
জরিপের তথ্য বলছে, গাজীপুরে যেসব মশা পাওয়া গেছে তার মধ্যে ৭৬ দশমিক ৪ শতাংশ এইডিস ‘অ্যালবোপিকটাস’ এবং ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ এইডিস ইজিপ্টি মশা।
এজিপ্টি হল- এমন একটি মশা যা ডেঙ্গু জ্বর, চিকুনগুনিয়াসহ অন্যান্য রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। অপরদিকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ ছড়ায় ‘এইডিস অ্যালবোপিকটাস’।
মশা নিধনে কেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রহমত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের প্রতিবেদন তিনি পাননি। মশা নিয়ন্ত্রণে কী করা হচ্ছে তা নিয়ে বক্তব্যও দিতে চাননি।
এর বদলে তিনি মশা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত কার্যক্রমের ওপর করা প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পাঠান। এতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে নানা কার্যক্রমের তথ্য রয়েছে।
এতে দেখা যায়, কোথাও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলে ওই বাড়ির আশপাশে ‘ফগিং ও লার্ভিসাইডিং’ করা হয়। গত জুন থেকে গত ৮ অগাস্ট পর্যন্ত ১৭টি ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং ১৪০টি বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে।
রাঙামাটি শহরের বিভিন্ন এলাকায় মশার ওষুধ স্প্রে করতে শুরু করেছেন পৌরসভার কর্মীরা।
অপরদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের ৭০৫টি বাড়িতে ৩০ জুলাই থেকে ৩ অগাস্ট পর্যন্ত জরিপ চলে। এরমধ্যে ৯৫টি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। এগুলোর ৬৩৮টি পাত্রের মধ্যে ১৩৮টিতে মেলে লার্ভা।
এসব ওয়ার্ডের মধ্যে ১১টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে একটি ওয়ার্ডে ১১৩ এবং আরেকটিতে ব্রুটো ইনডেক্স মিলেছে ১০০। নারায়ণগঞ্জে পাওয়া মশার মধ্যে ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ এইডিস এজিপ্টি এবং ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ অ্যালবোপিকটাস।
এ সিটির মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কীভাবে জরিপ করেছে, কার সঙ্গে কথা বলেছে তা মেয়রকে জানায়নি।
“তারা অ্যালার্মিং দেখাইছে। কিন্তু আমাদের এখানে পেশেন্টও নাই সেভাবে। যাই হোক আমরা সারা বছরই মসকিউটো অয়েল দিই। এখনও আমাদের কর্মীরা অভিযান চালাচ্ছেন। লার্ভিসাইডিং করছি, তেল দিচ্ছি, নানা ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছি।”
গত ৫ থেকে ৯ জুলাই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৭, ৮, ১০, ১৩ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব ওয়ার্ডের ৭৫টি বাড়িতে গিয়ে ২৮টিতেই লার্ভা পান জরিপকারীরা। ৭৩টি ভেজা পাত্রের মধ্যে ৩৫টিতে লার্ভা পাওয়া যায়।
এসব ওয়ার্ডে হাউজ ইনডেক্স ৩৭ দশমিক ৩ এবং গড় ব্রুটো ইনডেক্স ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ নগরীতে যত লার্ভা পাওয়া গেছে তার মধ্যে এইডিস ইজিপ্টি ২০ শতাংশ এবং এইডিস অ্যালবোপিকটাস ৮০ শতাংশ।
গ্রামেও এইডিসের ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় থেকে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রোগী ১৬৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। একই সময়ে পটুয়াখালী উপজেলায় ৬০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন সকাল পর্যন্ত। নগরীর পাশাপাশি জেলা ও উপজেলার হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।
জরিপকারীরা জানিয়েছেন, ওই অঞ্চলে এইডিস অ্যালবোপিকটাস মশার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। তবে কত শতাংশ সেটা আলাদা করা হয়নি।
গত ১ ও ১০ অগাস্ট যশোর পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডে জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপের ২০টি বাড়িতে গিয়ে ১১টি এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অর্থাৎ যতগুলো বাড়ি পরিদর্শন হয়েছে তার ৫৫ শতাংশেই লার্ভা পাওয়া গেছে। যশোরের ওই দুটি ওয়ার্ডের ব্রুটো ইনডেক্স ৮০।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এসব এলাকায় এইডিস মশার উপস্থিতি পেয়েছি। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছি। তারা সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তবে যশোর পৌরসভা অনেক বড় এলাকা। প্রতিদিন সব জায়গায় মশার ওষুধ দেওয়া সম্ভব না।”
মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বিপদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ ছাড়া বাকি এলাকা থেকে অল্প নমুনা নিয়ে জরিপ করা হয়েছে। তাই এটা দিয়ে মশার উপস্থিতির সঠিক চিত্র পাওয়া কঠিন। তবে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এইডিস মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে কিছু জায়গায় জরিপ চালিয়েছেন তিনিও। সেখানেও মশার ঝুঁকিপূর্ণ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
এমন অবস্থায় সামনে খারাপ সময় আসার শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি মশা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জরিপের জন্য তারা যে নমুনা নিয়েছেন সেটি ঢাকার তুলনায় কম। তবে মশার উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
“ঢাকার চেয়ে বাড়িঘর, মানুষজনও কম সেসব এলাকায়। গবেষণায় স্যাম্পল সাইজ আনুপাতিক হারে নির্ধারণ করা হয়। কাজেই মশার উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি এটাই বিবেচনায় নিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি ধরেই কার্যক্রম চালাতে হবে।”
তিনি বলেন, মশা বেশি থাকায় ঢাকার বাইরেও রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে মশা নিধন জরুরি।
ঢাকার বাইরে রোগী বাড়লেও মশক নিধনে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই জানিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, “আমি মঙ্গলবার মানিকগঞ্জে গিয়েছিলাম। সেখানে আড়াইশর মতো রোগী ভর্তি। একইভাবে অন্য জেলাগুলোর অবস্থাও তাই। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে মশা কমাতে হবে।”
somoyerkotha24.com