হেলাল উদ্দিন, বাগমারা (রাজশাহী): আট বছর আগে পাশের উপজেলা দুর্গাপুরে এক ছোটবোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কেঁচো সার ( ভার্মি কম্পোস্ট) বিষয়ে শুনেছেন গৃহবধূ তারা বিবি (৪৯)। ওই বোন কৃষি অফিসে চাকরি করেন। তার কাছ থেকে জেনে আগ্রহটা বেড়ে যায়। মনের ভেতরে খুঁত খুঁতানি ভাব থেকে যায়, নিজ বাড়িতে সার তৈরি। করতে হবে তারও প্রাথমিক ধারণা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। সে থেকে নিজ বাড়িতে কেঁচোসার তৈরি করছেন তারা বিবি। এখন তিনি এখন সফল উদ্যোক্তা। তাঁকে অনুকরণ করে অনেকেই এগিয়ে আসছেন এই পেশায়।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের সূর্যপাড়া গ্রামের মঞ্জুর রহমানের স্ত্রী তারা বিবি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা এই নারীর বিয়ে হয় ৩৩ বছর আগে। স্বামী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার তাঁর। অভাবের সংসারের হাল ধরে টেনে তুলছেন এই অদম্য নারী।
সরেজমিনে গৃহবধূ তারা বিবিকে সারের চৌবাচ্চার পরিচর্যা করত দেখা যায়। একটি টিনের ঘর ও বারান্দার সামনে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। কৃষিবিভাগ থেকে সাইনবোর্ডটি বসানো হয়েছে। বারান্দা আর ঘর মিলে বসানো রয়েছে ৪০টি চৌবাচ্চা। সারের বস্তা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে চৌবাচ্চাগুলো। পাশে রয়েছে গোবরের স্তুপ। বাড়ির ভেতরে রয়েছে দুইটি গরু। এই গরু দুইটির গোবর ব্যবহার করা হয় কেঁচো সার তৈরিতে।
সেখানে কথা হয় তারা বিবির সঙ্গে। গল্পো শোনালেন এই পেশায় এগিয়ে আসার। তিনি জানান, বোনের কাছ থেকে ধারণা নিয়ে সেখান থেকে এক হাজার টাকায় এককেজি কেঁচো কিনে চারটি চৌবাচ্চায় শুরু করেন। একটু সমস্যা হলে ছুটে যান উপজেলা কৃষি অফিসে। এটাই ছিল বাড়ির বাইরে কোনো সরকারি অফিসে যাওয়া। তবে হতাশ হননি সেখানে গিয়ে। পরামর্শ নিয়ে বাড়িতে এসে কেঁচো সার তৈরি করেন। চারটি চৌবাচ্চা থেকে এখন ৪০টি হয়েছে। উৎপাদনও বেড়েছে। আর পেঁছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন উপজেলা কৃষি অফিসারসহ এলাকার দায়িত্বে থাকা কৃষি কর্মকর্তারা তাঁর বাড়িতেই ছুটে আসেন।

তারা বিবি বলেন, তাঁর এই কাজে স্বামী ও সন্তানেরা সহযোগিতা করেন। শুরুতে প্রতিবেশীরা এই কাজে ঘৃণার পাশাপাশি হাসাহাসি করলেও এখন অনেকেই এগিয়ে আসছেন। সংসার দেখাশোনার পাশাপাশি কম খরচে এই সার তৈরি করা যায়। বাড়িতে দুইটা গাভি পালন করছেন, তা থেকেই আধাপচা গোবর পাওয়া যায়। চৌবাচ্চাতে এই আধাপচা গোবর এবং আধা কেজি কেঁচো চৌবাচ্চাতে রেখে সার তৈরি করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে সার তৈরি হলে তা চালুনি দিয়ে ছেকে সার তৈরি করা হয়। আফ্রিকান জাতের এই কেঁচো বেশি পরিমাণ খাবার খায় এবং মল ত্যাগ করে।
প্রতি মাসে ৩০-৩৫ মণ সার পাওয়া যায়। প্রতি মণ সার বিক্রি হয় ৪৯০-৫০০ টাকা মণ দরে। এলাকায় এর চাহিদাও রয়েছে। পানবরজ, সবজি, ফলের বাগানসহ বিভিন্ন ফসলে এই সার ব্যবহার করা হয়। লোকজন আগ থেকে সারের জন্য বলে রাখেন। পরে এসে নিয়ে যান। এছাড়াও প্রতিমাসে পাঁচ কেজি কেঁচো বিক্রি করেন। প্রতিকেজি কেঁচোর বাজার দর ১০০০-১১০০ হলেও তিনি ৮০০-৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। লোকজনের মধ্যে আগ্রহ তৈরির জন্য কম দামে বিক্রি করেন বলে জানিয়েছেন। বাড়িতে বসে প্রতি মাসে আয় করেন ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, চাষাবাদে জৈবসার খুবই গুরুত্বপূর্ণ তবে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। কেঁচো সার ব্যবহারে ব্যবহার করলে তা পূরণ করে। এছাড়াও শীতকালে মাটি ঝরঝরে ও গরম থাকে, অপর দিকে গরম কালে মাটি নরম ও ঝরঝরে থাকে। কৃষকেরা কম দামে এই ব্যবহার করতে পারেন।
পানচাষি আলমগীর হোসেন, আলতাফ হোসেন, মমতাজ, ফলচাষি হিরণ জানান, তাঁরা এই কেঁচোসার ব্যবহার করে উপকার পান। এজন্য তারা বিবির কাছ থেকে সার কেনেন। তাঁরা জানান, কম দামে কেনা এই সার ব্যবহারে ভালো ফলন পাওয়া যায়। কীটনাশকও ব্যবহার করতে হয় না।
গৃহবধূর স্বামী মঞ্জুর রহমান জানান, তিনি কৃষিকাজ করে কোনো রকম সংসার চালালেও এখন অভাব দূর হয়েছে। তাঁর পাশাপাশি স্ত্রীও সংসারের হাল ধরেছেন কেঁচো সার তৈরিতে। সন্তানের লেখাপড়াসহ টাকাও জমানো যায়। ছেলে তুষ্টিকুল ইসলাম (১৫) ওরফে তুষার জানায়, সে মায়ের কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। মায়ের কাজ ও উদ্যোগকে ঘৃণা নয়, পছন্দ করেন। মায়ের এই পেশার জন্য গর্ব করে বলে জানায়।
তারা বিবিকে অনুসরণ করে, আবদুল মান্নান, আফজাল হোসেন, এরশাদ আলী, আকরাম হোসেনসহ বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসেছেন কেঁচোসার তৈরিতে। তাঁদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন প্রাথমিকের গণ্ডিতে থাকা তারা বিবি। এই ব্যবসাকে ঘৃণা না করে অন্যদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন।
বাগমারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক তারা বিবি সম্পর্কে বলেন, তিনি বাড়িতে কেঁচোসার তৈরি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি সমাজের জন্য কাজ করেছেন। স্থানীয় কৃষিবিভাগ তাঁকে উৎসাহিত করে ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। তাঁকে অনুসরণ করে অন্যদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন।