অনলাইন ডেস্ক : আসন্ন রমজান মাসের আগে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার নিউমার্কেট এবং এর আশপাশের ব্যবসায়ীরা।
মূলত এই সময়টিকে ব্যবসার জন্য সেরা সময় বলে মনে করা হলেও তারা সংগ্রাম করছেন কারণ বাংলাদেশি ক্রেতা তথা পর্যটকরা খুব বেশি সংখ্যায় সেখানে যাচ্ছেন না। এতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কলকাতার ব্যবসায়ীদের অনেকে।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, কলকাতার নিউমার্কেট এবং এর আশপাশের কিছু ব্যবসায়ী ইতোমধ্যেই তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখনও যারা ব্যবসা সচল রেখেছেন তাদের অনেকেই আর নিশ্চিত নন ঠিক কতক্ষণ তারা এটি চালিয়ে যেতে পারবেন।
ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা গত বছরের আগস্টে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। হাসিনার পলায়নের পর বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন এখনও আগের মতো পর্যটক ভিসা দেওয়া শুরু করেনি বলে সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশিদের মাত্র অল্প কিছু সংখ্যক মেডিকেল ভিসা দেওয়া হচ্ছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় এই নিষেধাজ্ঞা সীমান্তের ওপারে তথা পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসায় ক্ষতির কারণ হয়েছে।
মির্জা গালিব স্ট্রিটের (ফ্রি স্কুল স্ট্রিট নামে পরিচিত) বাজেট হোটেল গুলশান প্যালেসের লবি গত বৃহস্পতিবার বিকেলে খালি দেখা যায়। এসময় একজন রিসেপশনিস্টকে তার মোবাইলের স্ক্রিনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় এবং আর মালিক আর.কে. তারা সেসময় তার ডেস্কে বিক্রেতার বিলগুলোতে স্বাক্ষর করছিলেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি না (এই পরিস্থিতিতে) কিভাবে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে। হোটেলটিতে ১৩টি কক্ষ রয়েছে। বছরের এই সময়ে মাসের একটি দিনও এসব কক্ষ খালি থাকে না। বৃহস্পতিবার সেখানে মাত্র চারটি কক্ষে অতিথি ছিলেন, তাদের কেউই বাংলাদেশ থেকে আসেননি। মাসের পর মাস ধরে এভাবেই চলছে। এমনকি অর্ধেক রুমও বুক হচ্ছে না।”
বাজেট এই হোটেলে একটি নন-এসি রুমের দৈনিক ভাড়া আগে ছিল প্রায় ১১০০ রুপি, পর্যটক না থাকায় সেই ভাড়া এখন নেমে এসেছে ৬০০ রুপিতে। আগে একটি এসি রুমের প্রতিদিনের স্বাভাবিক ভাড়া ২০০০ রুপি হলেও তা এখন কমে এসেছে ১২০০ রুপিতে।
তিনি বলেন, “আমরা আর কি করতে পারি? আমাদের আরও খরচ আছে যা বহন করতে হবে, যাই হোক না কেন। আমাকে বিদ্যুৎ বিল, ট্যাক্স এবং কর্মীদের বেতনও দিতে হবে।”
নিউমার্কেটে সালোয়ার স্যুট বিক্রি করে এমন একটি দোকান হচ্ছে শ্রিংগার। দোকানটির ভেতরে চারজন লোক রয়েছেন যারা সবাই দোকানের কর্মচারী। দোকানের ম্যানেজার বলছেন, “ব্যবসা ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। রমজানের আগে এমন দিনগুলোতে দোকানে ব্যাপক ভিড় দেখা যেত। দোকানে কাস্টমার ভরা থাকতো। ১০ জনের মধ্যে সাতজনই ক্রেতা থাকত বাংলাদেশ থেকে।”
মারকুইস স্ট্রিটে শামসি ফ্যাশন-এ শাড়ি এবং স্যুট বিক্রি হয়। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। দোকানের মালিক কামরুদ্দিন মল্লিকের পাল্টা প্রশ্ন, “আমাকে মাসিক আড়াই লাখ রুপি ভাড়া দিতে হয়েছে। অন্যান্য আরও খরচআছে আড়াই লাখ রুপি পর্যন্ত। ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে আমি কতক্ষণ প্রতি মাসে ৫ লাখ রুপি খরচ করতে পারি?”
মারকুইস স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কিড স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড এবং নিউমার্কেটের আশপাশের এলাকাগুলো আগে বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটক ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখরিত থাকতো। যেসব দোকানে শাড়ি, শেরওয়ানি এবং সালোয়ার স্যুট বিক্রি হয়; ভোজনরসিক সুস্বাদু বাংলা খাবারের আয়োজন করে যেসব হোটেল; এছাড়া আবাসিক বিভিন্ন হোটেল, গেস্ট হাউস, ট্রাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর, কারেন্সি চেঞ্জার এবং এমনকি রাস্তার বিক্রেতারাও— সবই নির্ভর করে বাংলাদেশি পর্যটকদের ওপর।
এখন সেখানকার নির্জন রাস্তা এবং খালি দোকানগুলো যেন এক সময়ের ব্যস্ত বাণিজ্য কেন্দ্রের বিষণ্ণ চিত্রটাকেই তুলে ধরছে। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হায়দার আলী খান বলছেন, “বেশ কিছু হোটেল মালিক যারা ভবন ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তারা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ তারা আর ভাড়া দেওয়া চালিয়ে যেতে পারেননি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।”
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের জনপ্রিয় খাবারের দোকান প্রিন্সের মালিক চয়ন সাহা বলেছেন, তিনি তার ব্যবসার কাঁচামাল সংগ্রহের পরিমাণ “উল্লেখ্যযোগ্যভাবে” কমিয়েছেন। তিনি বলছেন, “আমার গ্রাহকদের ৮০ শতাংশই ছিলেন বাংলাদেশি। এখন, তারা নেই।”
আজিজুর রহমান খান এবং স্ত্রী সোনিয়া ওই রেস্টুরেন্টে কিছুক্ষণ আগেই দুপুরের খাবার শেষ করেছেন। আজিজুর বাংলাদেশ থেকে মেডিকেল ভিসায় এসেছেন। তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন এবং থিয়েটার রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছেন।
তিনি বলেন, তিন মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষার পর আমরা ভিসা পেয়েছি। তিনি কয়েকদিন আগে ঢাকা থেকে বাসে এসেছেন এবং রোববার ফিরে গেছেন।
মার্কুইস স্ট্রিটের কারেন্সি এক্সচেঞ্জার শ্যামল সাহা এখন প্রতিদিন মাত্র ৩০০ মার্কিন ডলারের লেনদেন করছেন, যা গত বছরের এই একই সময়ে ছিল ৫ হাজার মার্কিন ডলার। তার মতে, “পর্যটক ভিসা আবারও দেওয়া শুরু না হলে, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।”