• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • ১লা এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  • somoyerkotha24news@gmail.com
  • +880-1727-202675

মব জাস্টিস শাস্তিযোগ্য অপরাধ

প্রকাশ: শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫ ৩:১৪

মব জাস্টিস শাস্তিযোগ্য অপরাধ

উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার কারণে গত ২৯ জানুয়ারি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নারীদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়। আগের দিন অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি একদল মানুষ মিছিল নিয়ে খেলার মাঠের বিভিন্ন স্থাপনা  ভাঙচুর করে। নারীদের ফুটবল ম্যাচ নিয়ে স্থানীয় মুসল্লিদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছিলো। এর আগে গত নভেম্বরে নারায়ণগঞ্জে আপত্তির মুখে দুই দিনব্যাপী ‘মহতি সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ করা হয়। ওই মেলায় নাচ–গানসহ ‘অনৈসলামিক’ কার্যক্রম চলে বলে অভিযোগ আনা হয়েছিলো। গত  ১ মার্চ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ‘রহিম শাহ বাবা ভান্ডারি মাজারে’ ওরসের নামে গানবাজনা, মাদক সেবনসহ অশ্লীল কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ তুলে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। একই দিনে রাজধানীর লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে  দুই তরুণীকে লাঞ্ছিত করা হয়। পুলিশ বলছে, এক তরুণীর ধূমপান নিয়ে আপত্তি তুললে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে জড়ো হয়। একপর্যায়ে রিংকু নামের এক ব্যক্তি তরুণীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও শারীরিক লাঞ্ছনার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে পুলিশ  রিংকুকে গ্রেপ্তার করে। 
মার্চ রাতে নেত্রকোনায় কেন্দুয়ায় মাসকা বাজারসংলগ্ন হজরত শাহ নেওয়াজ ফকিরের মাজারে ওরসে গানবাজনা ও মাদক সেবন করা হবে এমন অভিযোগ করে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা ভাঙচুর করে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এতে ওই দুজন আহত হন। তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এই দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাঁদের মারধর করা হয়। এসবই সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের একটি অংশ মাত্র। এরও আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে ‘ডাকাত’ সন্দেহে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে  মারা  হয়েছিলো । ২০১৯ সালে বাড্ডায় তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মা’কে ছেলেধরা সন্দেহে উচ্ছৃঙ্খল জনতা পিটিয়ে মেরে ছিলো। এ সবই হলো ‘মব জাস্টিস’। তবে বাংলাদেশে এই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে সেটা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দিয়ে মারার মতো ঘটনা।
ইংরেজি Mob Justice  এর  Mob শব্দের অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা আর Justice শব্দের অর্থ হলো বিচার বা ন্যায়বিচার। Mob Justice  শব্দের অর্থ হলো উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। একে উচ্ছৃঙ্খল গণবিচার, মব রুল বা মবোক্রেসিও বলা হয়।‘মব জাস্টিস’  বলতে আইন জনতার নিজের হাতে তুলে নেওয়াকে বোঝানো হয়। কোনো অপরাধীকে যখন আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিচার না করে উত্তেজিত জনতা নিজেরাই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় বা দেওয়ার চেষ্টা করে তখন তাকে ‘মব জাস্টিস’  বলে । মব জাস্টিসকে আইনগতভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড়ো বাধা। এর ফলে অনেক সময় নিরীহ মানুষও অন্যায়ের শিকার হয়ে পড়ে। মব জাস্টিসের মাধ্যমে কোনো ন্যায়বিচার হয় না। কারণ, এখানে সাক্ষী, বিচারক ও শাস্তিদাতা সবকিছুর ভূমিকায় থাকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রাচীনকাল থেকেই মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে ।  ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতজ্ঞ হাইপেশিয়া-কে একদল উন্মত্ত জনতা মব জাস্টিসের মাধ্যমে হত্যা করে। বিগত শতকগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে । হিস্ট্রি চ্যানেলের তথ্য অনুযায়ী, কালো জাদুচর্চার অভিযোগে ১৬৯২ ও ১৬৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে ২০ জনকে ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে  মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো। তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পেছনে কাজ করেছিল কুসংস্কার, জনরোষের ভয় ও ধর্মীয় উগ্রবাদ। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিলো, তার একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য ছিল মব জাস্টিস। সে সময় প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে হামলা চালিয়েছিলো উচ্ছৃঙ্খল জনতা। শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়েছিল বহু মানুষকে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলোতে মব জাস্টিসের প্রবণতা বেশি। সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৪ জুন ভারতে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটছে। ভারতে গরুর মাংসকে কেন্দ্র করে প্রায়ই মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। ৭ জুন ছত্তিশগড় রাজ্যের রাইপুরে গরু চোরাচালানের অভিযোগে মুসলিম দুই ব্যক্তিকে মারধর করে হিন্দুত্ববাদী উচ্ছৃঙ্খল জনতা। ওই ঘটনায় আহত একজন কিছুদিন পরে মারা যান। এক নারী ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ  করার কারণে ২৪ জুন ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদা জেলায় ঐ নারীকে হত্যা করে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। পাকিস্তানেরও উচ্ছৃঙ্খল জনতার আইন হাতে তুলে নেওয়া খবর প্রায়ই সামনে আসে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে মব জাস্টিসের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটে ধর্ম অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট পাঞ্জাব প্রদেশের ফয়সালাবাদ জেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি ও গির্জায় প্রায় ১০ ঘণ্টা ধরে হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনার পর ১৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ছাড়া গত বছরের জুনে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত জেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে থানা থেকে একজন খ্রিষ্টান পর্যটককে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা সে সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ইন্দোনেশিয়ায় এক বছরে কম-বেশি সাড়ে চার হাজারের মতো মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। অনুরূপ প্রবণতা শ্রীলঙ্কায় লক্ষ্য করা যায়।
আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা, ঘানা ও কেনিয়ায় মব জাস্টিসের প্রবণতা বেশি । এই দেশগুলোয় চুরি ও ডাকাতি বেশি হয়। আর মব জাস্টিসের শিকারও হয় চোর-ডাকাতরা বেশি। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসেবে, গত এক দশকে নাইজেরিয়ায় অন্তত ৫৫৫ জন মব জাস্টিসের শিকার হয়েছে। আর ২০২৪ সালের মার্চে প্রকাশিত ‘হোয়াই উই কিল’ বইয়ের লেখক কার্ল কেম্পের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ১ হাজার ৮৯৪ জন মব জাস্টিসে প্রাণ হারিয়ে ছিলেন।  রিলিফ ওয়েবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর ওই গণহত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে হত্যা করেছিল উত্তেজিত জনতা।
 ‘মব লিঞ্চিং’ নামে একটি শব্দ আছে।‘লিঞ্চিং’ হলো সহিংসতার একটি রূপ যেখানে জনতা বিনাবিচারে, প্রায়শই নির্যাতন এবং শারীরিক অঙ্গহানি ঘটিয়ে কোনো ‘অভিযুক্তকে’ মৃত্যুদণ্ড দেয়। মধ্যযুগের জার্মানিতে কিছু আদালত তৈরি করা হয় যা ‘লিঞ্চিংয়ে’ জড়িত ছিলো। ইংল্যান্ডের সীমান্ত জেলায়ও অতীতে এ ধরনের বিচার দেখা যেত। মধ্যযুগের স্পেন, রাশিয়া, পোল্যান্ডেও এমন আদালত ছিলো। যার বেশিরভাগ পরিচালিত হতো ইহুদিদের বিরুদ্ধে। এসব আদালত গঠনে বৈধ কর্র্তৃপক্ষের অনুমোদন ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮২ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে ৪ হাজার ৭৩০  জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে ১ হাজার ২৯৩ জন শ্বেতাঙ্গ এবং ৩ হাজার ৪৩৭ জন কালো । এমনকি ১৯৫০-৬০  এর দশকেও আমেরিকাতে জাতিগত অস্থিরতার সময়ও এই ‘মব লিঞ্চিং’ দেখা গেছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসেবে, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাত মাসে গণপিটুনিতে দেশে  অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৪ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
দেশ ও পরিস্থিতিভেদে মব জাস্টিসের কারণ ভিন্ন হতে পারে। তবে এর পেছনে মূল একটি কারণ হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়া । মব জাস্টিস সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অভাবের কারণেও ঘটে থাকে। মব জাস্টিসের পেছনে বড়ো ভূমিকা পালন করে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে দেওয়া বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য। বেশিরভাগ মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে স্বল্প সময়ের মধ্যে, উন্মত্ত জনতা পাগলের মতো সহিংস হয়ে ওঠে বিচার করবার জন্য। কখনো অনুভূতির দোহাই দেওয়ার মাধ্যমে, কখনো বা গুজব ছড়িয়ে, কখনো দীর্ঘদিনের রাগ থেকে, বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য, চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে দাবি আদায় কিংবা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মব জাস্টিসের মতো ঘটনা সৃষ্টি করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিপূর্ণভাবে সক্রিয় না থাকলে মব জাস্টিস সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজের বিভিন্ন অংশ তখন নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য একত্র হয়ে বিশৃঙ্খলা করে।
  বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। অন্তর্বর্তী সরকার মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না –এমন বার্তা অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা একাধিক বার দিয়েছেন। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে মব জাস্টিসের মতো অপরাধগুলো ধীরে ধীরে সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব।

ইমদাদ ইসলাম

সর্বশেষ সংবাদ

 

রাজনীতি-এর আরও সংবাদ

 



সম্পাদক ও প্রকাশক : ইয়াকুব শিকদার

ঢাকা অফিস: ১২১,ডি.আই.টি, এক্সটেনশন রোড, ফকিরাপুল, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০। রাজশাহী অফিস: বহরমপুর (সিটি বাইপাস), জিপিও-৬০০০, রাজপাড়া, রাজশাহী। ই-মেইল: somoyerkotha24news@gmail.com, মোবাইল: 01727202675