স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর বাগমারা, মোহানপুর ও দুর্গাপুরে গেল তিন বছরে ৮টি পানের বরজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে চাষীদের। তদুপরি ক্ষয়ক্ষতির শিকার ভুক্তভোগিদের থাকে না কোনো অভিযোগ। ফলে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে দ্বারস্ত হয় না চাষীরা। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু করার থাকে না, এমনই দাবি। ফলে পানবরজে আগুন সন্ত্রাস ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
অগ্নিকাণ্ডের বিষয়গুলো নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বারদের ধারণা শত্রুতার জেরে বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা আগুন দিতে পারে। কাউকে শনাক্ত করা যায় না। তাই আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যায় না। তবে এমন ঘটনার পরে বিভিন্ন সরকারি দফতরে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের তালিকা দেওয়া হলেও তারা কোনো ধরনের সহযোগিতাও পায় না। ফলে পুনরায় পান চাষে ফিরতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় ক্ষতিগ্রস্তদের।
চলতি বছরের ১৬ জুনে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়ের গোপালপুরের বড় বাগিচা বিলে আহাদ আলী, লোকমান আলী, মুনসুর আলী, দেলোয়ার হোসেনহ আট চাষীর পানের বরজ সন্ত্রাসীদের আগুনে পুড়ে যায়।
তাদের একজন ৬৫ বছর বয়সের গোপালপুরের বাসিন্দা মৃত নাসের আলীর ছেলে আহাদ আলী। তার একমাত্র সম্বল ৫ কাঠা জমির পানের বরজ। চোখের সামনে জীবন-জীবিকার সম্বল পানের বরজ পুড়তে দেখেছেন আহাদ। তবে জানেন না কে করেছেন তার এমন সর্বনাশ। এই বিলে আহাদ আলীসহ ৮ চাষীর প্রায় ২০ বিঘা জমির পানের বরজ পুড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষীরা অন্য ফসল ফলাতে পারলেও আর্থিক সঙ্কটের কারণে জমি চাষে নামতে পারেন নি।
আহাদ আলী বলেন, ‘তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আগে আলাদা খেতাম। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে ছোট ছেলের কাছে খাই। নিজের চিকিৎসা, ওষুধসহ যাবতীয় খরচ এই পানের বরজ থেকে আসতো। সেই পানের বরজ পুড়ে গেছে। খুব কষ্ট করে চলতে হচ্ছে এখন। পেলে খাই, না পেলে না খাই। আগুন দিয়েছে কে ধরা যায় না। পানের বরজের সাথে আগুনে আমার সব পুড়ে গেছে।’
এ বছরের ১৬ জুনে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে লোকমান আলী, মুনসুর আলী, দেলোয়ার হোসেনহ আট চাষীর পানের বরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে পুড়ে যাওয়া পানের বরজের জায়গায় লোকমান, মনসুর, দেলোয়ারেরা সবজির চাষ করছেন। তবে দুঃখজনক হলেও আহাদ আলীর জমি ফাঁকা পড়ে আছে। কারণ অর্থিক সঙ্কটের কারণে তিনি জমিতে কিছু চাষ করতে পারেননি। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি সরকারিভাবে সহযোগিতার।
স্থানীয় ও জাতীয় কয়েকটি গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল মোহনপুর কেশরহাটের বিশালপুরে অগিুকাণ্ডে সাইফুল ইসলামের ১২ কাঠা পান বরজ পুড়েছে। সাইফুল ইসলাম লিজ নিয়ে পানের বরজটি করেছিলেন। আগুনে পানবরজ পুড়ে যাওয়ায় তিনি নিজেকে নিঃস্ব বলে দাবি করেন। ১৯ মার্চ দুর্গাপুরের শিবপুরে বাড়ির রান্নাঘর থেকে আগিুকাণ্ডে ৪০ বিঘা জমির পানের বরজ পুড়েছে।
ভুক্তভোগী পানচাষি রনি, রুবেল, আশরাফুলসহ কয়েকজন জানিয়েছিলেন, রান্নাঘরে সর্বপ্রথম আগুন লাগে, সেই আগুন পানের বরজগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্গাপুর ফায়ার সার্ভিসের দলনেতা মাহাবুর রহমান জানিয়েছিলেন, আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভাষ্য- তাদের প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে থাকা শতাধিক পানের বরজ পুড়েছে। ২০২১ সালের ২ এপ্রিল দুর্গাপুরের গোপালপুরের নামুপাড়ায় আগুনে পুড়ে গেছে কৃষকের ১০ বিঘা জমির পানের বরজ। এতে ইব্রাহিম নামের এক ব্যক্তির শরীরে কিছু অংশ পুড়ে যায়।
অন্যদিকে, রাজশাহীর বাগমারায় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে খোকাবাবু নামের এক ব্যক্তির পানবরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ লাখ টাকার মত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পানবরজের মালিক খোকাবাবু স্ত্রী রেখা বিবি। ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাগমারার বাসুপাড়ার ইয়াদ আলীর পানের বরজে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল বাগমারায় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে আয়েন উদ্দীন নামের এক কৃষকের পানবরজ পুড়ে ভষ্মিভুত হয়ে গেছে। এতে আয়েন উদ্দীনসহ সাইদের সমস্ত পান বরজ পুড়ে যায়। গনিপুর ইউনিয়নের চকমহব্বতপুরে কৃষকের পানবরজে পূর্বশত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন আগুন লাগিয়ে দেয়।
চলতি বছরের ১৬ জুন দুর্গপুরের গোপালপুরের বড় বাগিচা বিলে আগ্নিকাণ্ডে পানের বরজ পুড়েছে মনসুর রহমানের। এ বিষয়ে মনসুর রহমান বলেন, পান বিক্রির টাকায় আমাদের জীবন জীবিকা চলে। পানে প্রতিদিন টাকা পাই। আজকে পান ভাঙ্গবো আজকেই টাকা পাব। কিন্তু এই টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার পানের বরজ পুড়ে গেছে আগুনে। বেশির ভাগ রাতের আধারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পানের বরজে কে আগুন দেয়। কেউ জানে না। আমার ১৮ কাটা জমির ৩ লাখ টাকার পান পুড়ে গেছে। এর সাথে বিভিন্ন জিনিসপত্র (বাঁশ, বাতা, খেড়, বর ঢাকা কাপড়) মিলে আরো তিন লাখ টাকার হবে। ঘটনার পরে কৃষি কর্মকর্তারা তেমন আসেন না। তাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতাও পাওয়া যায় না।
বড় বাগিচা বিলে একইদিনে লোকমান আলীর ১৭ কাঠার পানের বরজ পুড়েছে। তিনি বলেন, রাত ১১টার দিকে আগুন দিয়েছিল। সেই সময় এই বিলে কেউ থাকে না। হিংসের কারণে বা মাদক খেয়ে আগুন দেয়। হিংসার বসত একজনকে মারতে গিয়ে ২০ জন চাষীকে মারছে। তার ১৭ কাঠায় ৬ থেকে ৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। অনেক সুন্দর পানের বরজ হয়েছিল তার।
অপরদিকে, পানের বরজে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো নাশকতামূলক বলে দাবি করেন দুর্গাপুর ফায়ার সার্ভিসের লিডার শাহিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা খবর পাওয়া মাত্রই রওনা দেয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়েন্ত্রণে আনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয়রা আগুন নেভায়। আমাদের ধারণা পানের বরজে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো নাশকতা মূলক। কেউ আগুন ধরিয়ে দেয়। কেউ কেউ সিগারেট খেয়ে অসাবধানতাবশত ফেলে দেয়। এতে করে আগুন লেগে যায়। সবমিলে সচেতনার অভাব রয়েছে মানুষের মধ্যে।
এ বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শহিদুল ইসলাম বলেন, এই এলাকার মানুষের একমাত্র অর্থকরি ফসল পান। পান বিক্রি করে করে মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা উপজেলার সিংহভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা চলে। একটা পানের বরজ ঠিকঠিক প্রস্তুত করতে চাষীদের দুই বছরের বেশি সময় লেগে যায়। কিন্তু পানের বরজে কে আগুন দেয়, কেনো আগুন দেয় সেটা জানা যায়না।
তিনি বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের তালিকা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কোন ধরনের সহযোগিতা পায় না। সরকারিভাবে সহযোগিতা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত এই মানুষগুলো আবার পানের বরজ করতে পারতেন।
এ বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলার নওপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, বেশির ভাগ আগুন রাতে লাগে। আগুন কে দেয়, কেনো দেয়, তা জানা যায় না। প্রতিবছর এমন আগুনে পুড়ে অনেক চাষীর পানের বরজ নষ্ট হয়। এতে লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। আমরা আজও নির্দিষ্টভাবে জানতে পারিনি আগুন দেয় কে। এটা শত্রুতার জেরে হয়ে থাকে বলে তার ধারণা।
এ বিষয়ে দুর্গাপুর থানার ভাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, পানের বরজ পোড়ার ঘটনায় কেউ থানায় অভিযোগ দেয় না। তারপরেও আমরা ঘটনাগুলোর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করি। আসলে জানা যায় না কে, কেনো বা কারা আগুন দিয়েছে। বাগমারা থানার ওসি বলেন, সাধারণত পানের বরজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তেমন কেউ অভিযোগ করে না। মোহনপুর ওসি বলেন, তার এই থানায় যোগ দেওয়া ৪০ দিন হলো। এসময়ে পানের বরজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া তার জানা নেই বিষয়গুলো।
এ বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহেল রানা বলেন, বেশিরভাগ রাতে আগুন দেয়। কে দিল জানা যায় না। তবে পানের বরজ পুড়ে চাষীর ক্ষতি হয়। সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়া হয় আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের। ইতোপূর্বেও দেওয়া হয়েছে। তবে ক্ষতি যতটুকু হয়েছে সেই পরিমাণের না হলেও সহায়তা করা হয়। এছাড়া এলাকায় তার ও ফায়ার সার্ভিসের নম্বর দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রচারণা চালানো হবে বলে এই কর্মকর্তা জানান।
এ বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, আগুন কে বা কারা দেয়, জানা যায় না। ক্ষত্রিগ্রস্ত চাষীদের প্রণোদনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রণোদনা দেওয়া হয় না।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল আলম বলেন, কে আগুন দিয়েছে জানা যায় না। যেহেতু পানের বরজে আগুনের কারণে অনেক মানুষের ক্ষতি হয়। তাই মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুরের মানুষের মাঝে সচেতনামূলক কিছু করার কথা ভাবা হচ্ছে।