স্টাফ রিপোর্টার: শ্বাসনালিও ফুসফুসের সংক্রমণই হচ্ছে নিউমোনিয়া। সাধারণত নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হয় ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে। বিশ্বের লাখ-লাখ নবজাতক ও শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় প্রতিবছর। বাংলাদেশেও শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধানকারণ এই প্রতিরোধ যোগ্য রোগ। বলা হয়ে থাকে, দেশে পঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এখনও মৃত্যুর ‘মেজরকিলার’ হচ্ছে নিউমোনিয়া। এই রোগে আক্রান্ত হলে শিশুদের ফুসফুস পুঁজ ও তরলে ভরে যায়, যার কারণে তাদের নিঃশ্বাস নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়।
ইউনিসেফ বলছে, এই রোগটি বাংলাদেশে শিশুদের অন্যতম বড়ো ঘাতক, যার কারণে পাঁচ বছরের কমবয়সী ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়। বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যু বরণ করে। তবে বাংলাদেশে এ অবস্থা আরও খারাপ। দেশে প্রতিবছর ২৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। প্রতি ঘণ্টায় এ সংখ্যাটি আনুমানিক ২ থেকে ৩ জন। দশ বছর আগের তুলনায় সম্প্রতি নিউমোনিয়া পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনও প্রতি ঘণ্টায় এই রোগে একজন করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, অথচ নিউমোনিয়া প্রতিরোধ যোগ্য।
‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে থেকে জানা যায়, নিউমোনিয়া এবং সংক্রমণকে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ‘মেজরকিলার’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই জরিপকে দেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সবচেয়ে বড় জরিপ বলে বিবেচনা করা হয়।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, – এক মাস থেকে ১১ মাস বয়সী যত শিশু মারা যায়, তার মধ্যে অর্ধেক শিশু মারা যায় শুধু নিউমোনিয়া এবং সিরিয়াস ইনফেকশনে। একই সঙ্গে নবজাতক (শূন্য থেকে ২৮ দিন) মৃত্যুর তিনচতুর্থাংশ ঘটে অ্যাস্ফিক্সিয়া (জন্মকালীন শ্বাসরোধ), নিউমোনিয়া বা বড় কোনও সংক্রমণ, অপরিণত এবং কম ওজনের জন্য।
নবজাতক মৃত্যুর ঘটনাগুলো থেকে জানা যায়- অপরিণত এবং কম ওজনের কারণে ১৯ শতাংশ, জন্মকালীন শ্বাসরোধ এবং জন্মকালীন ইনজুরি রয়েছে ২৯ শতাংশ এবং নিউমোনিয়া ও সংক্রমণ রয়েছে ২৫ শতাংশ। এছাড়াও এক মাস থেকে ১১ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয় ৪৮ শতাংশ, ডায়রিয়াতে ১৪ শতাংশ এবংজন্মগত ত্রুটিতে ছয় শতাংশ। একই সঙ্গে ১২ মাস থেকে ৫৯ মাস অর্থ্যাৎ এক বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য সংক্রমণ ১৩ শতাংশ, ডায়রিয়াতে ছয় শতাংশ এবং পানিতে ডুবে মারা যায় ৫৯ শতাংশ।
সাধারণত যে সব নবজাতককে জন্মের পরপর শাল দুধ খাওয়ানো হয়না এবং বুকের দুধের পরিবর্তে যেশিশুকে কৌটার দুধ খাওয়ানো হয়, সে সব শিশুই নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। সেই সঙ্গে পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশু এবং যাদের ভিটামিন এ-র অভাব আছে সেই সব শিশুর নিউমোনিয়া ঝুঁকি বেশি। নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক টিকার আওতার বাইরে থাকা শিশুরাও এর অন্তর্ভুক্ত। এখানে উল্লেখ যে দেশে অত্যন্ত সফল ভাবে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে বিসিজি, ডিপিটি, নিউমোনিয়া ও হামেরটিকা। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, নিউমোনিয়া সব বয়সী শিশুর মধ্যে দেখা যায়।
ইউনিসেফ বলছে, “সবচেয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত শিশুরাই নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে সব থেকে বেশি। ধনী পরিবারেরে শিশুদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেক এবং তাদের পাঁচ বছরের জন্মদিনের আগেই মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও দ্বিগুণ। নিউমোনিয়ার কারণে শিশু মৃত্যু বন্ধের সম্ভাবনার অগ্রগতি যথেষ্ট তরান্বিত হয়নি। এর জন্য স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, পয়নিস্কাশন, স্বাস্থ্যবিধি এবং বায়ুদূষণ সহ আন্তঃখাত সমন্বয়ে প্রকল্প প্রয়োজন। ইউনিসেফ, সেভ দি চিলড্রেন ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা যৌথ ভাবে বাংলাদেশ সরকারকে নিউমোনিয়া মোকাবিলায় সহায়তা করে।”
শিশুর সর্দি, কাশি, সামান্য জ্বর, নাকে বাবুকে কিছু শব্দ হলেই নিউমোনিয়া হয়েছে এমন ভাবা যাবেনা। সর্দি, জ্বর, কাশি শিশুদের হরহামেশাই হয়, এর বেশির ভাগই ফ্লু, তাই ঘাবড়ানো যাবেনা। যে কোনো শিশু বছরে চার থেকে পাঁচ বার ঠান্ডায় আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে শহরের বেড়ে ওঠা শিশুদের এমনটা হয়ে থাকে। শিশুর জ্বর, সর্দি, কাশি বা শ্বাস-কষ্ট হলে খেয়াল রাখতে হবে শিশুর বুকের পাঁজরের নিচের অংশ ভেতর দিকে দেবে যাচ্ছে কিনা, অথবা শিশু দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে কিনা ,এই লক্ষণ গুলো থাকলে বুঝতে হবে শিশুর নিউমোনিয়া হয়েছে । আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন বমি বমি ভাব, খাবারে অনীহা, নিস্তেজ হয়ে পড়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া।
সব সর্দি-কাশিই নিউমোনিয়া নয়। সাধারণ সর্দি-কাশির জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক লাগেনা। কিন্তু অনেক সময় মা-বাবা নিকটস্থ ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে শিশুকে খাওয়ান বা আগে কখনো দেওয়া হয়েছিল, সেটা আবার কিনে খাওয়ান। এই প্রবণতা শিশুর জন্য ক্ষতিকর। পরবর্তী সময় অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করেনা। তাই শিশুর ঠান্ডা-জ্বর-কাশি হলে অস্থির হওয়া যাবেনা। তবে প্রাথমিক ভাবে জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল খাওয়ানো, নরম কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে দেয়া, নাক বন্ধ থাকলে লবণ পানির ড্রপ দিয়ে নাক পরিষ্কার করে দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সামান্য কাশির জন্য কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি হলে গরম পানি, মধু ও লেবু অথবা তুলসী পাতার রসে মধু মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। যদি কাশির সঙ্গে শব্দ হয় বা রাতের বেলা কাশি বাড়ে, তাহলে সালবিউটামল–জাতীয় সিরাপ দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে বুকের দুধের পাশাপাশি বাসার সব ধরনের খাবার খেতে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সন্তানকে প্রায় প্রতিদিন কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো জরুরি। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবেনা।
ঘরের দরজা–জানালা খুলে রাখাতে হবে যেন ঘরে পর্যাপ্ত আলো–বাতাস প্রবেশ করতে পারে এবং ছোট শিশুকে বারবার মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। নাক বন্ধ থাকলে অনেক মা-বাবা নেবুলাইজ করান। ডাক্তারও নেবুলাইজ করতে বলেন। এই পদ্ধতিতে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তা আসলে ফুসফুসে কাজ করে। বন্ধ নাক বা গলায় শব্দ হলে নেবুলাইজেশনে কাজ হয়না। শুধু শিশুর কাশি বেশি হলে বা শিশু কাশির জন্য ঘুমাতে না পারলে বা বমি হলে নেবুলাইজ করতে হয়, যাকে বাবা–মায়েরা সচরাচর বলেন গ্যাস দেওয়া। নিউমোনিয়ার কারনে যেসব জটিলতা হতে পারে এবং সেগুলোর দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। কারন নিউমোনিয়াতে হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে খিঁচুনি হওয়া এবংঅজ্ঞান হয়ে যায়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। যেগুলো শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়।
আগেই বলা হয়েছে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায়। প্রতিরোধের জন্য শিশুর জন্মের পরপরই শালদুধ খেতে দিন এবং ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বোতল দিয়ে কৌটার দুধ খাওয়ানো যাবেনা। ছয় মাস পর থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি বাসায় বানানো সুষম খাবার শিশুকে খেতে দিতে হবে। খাবারে সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল রাখতে হবে যেন শিশুর ভিটামিন এ-এর অভাব না হয়। শিশুকে সময়মতো রোগ প্রতিরোধী টিকা দিন। শিশুর সামনে ধূমপান করা যাবেনা, পরোক্ষ ধূমপান শিশুর ফুসফুসের ক্ষতি করে, বাড়িয়ে দেয় নিউমোনিয়ার আশঙ্কা। সচেতনতা শিশুর রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূ ভূমিকা রাখে। তাই বাবামাকেই শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হতে হবে। পরিবারের সচেতনতার মধ্যেই নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।