স্টাফ রিপোর্টার: চীনা অ্যাপ ই-মুভি প্ল্যানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কয়েকশো কোটি টাকা প্রতারণা করে পাচারের ঘটনায় রাজশাহীতে দায়ের হওয়া মামলাটির তদন্তভার নিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানা-পুলিশ মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেছে। এ মামলায় সিআইডি ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
এরা হলেন- ই-মুভি প্ল্যানের বাংলাদেশের এজেন্ট মোসাব্বির হোসেন (২৪) ও ঢাকা সিটি এজেন্ট সাইফুল ইসলাম (৩০)। মোসাব্বিরের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার কররা গ্রামে। আর সাইফুলের বাড়ি ফেনী। দুজনেই ঢাকায় থাকতেন। ঢাকা থেকেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মোসাব্বিরকে গত ১৩ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়। আর সাইফুল গ্রেপ্তার হয়েছেন বুধবার বিকালে।
মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক শাহিনুর ইসলাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি আসামি সাইফুলকে রাজশাহীর আদালতে হাজির করেন। শাহিনুর ইসলাম জানান, আদালতে সাইফুল নিজের দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। পরে আদালত তাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়েছেন।
এর আগে পুলিশের পাশাপাশি মামলাটির ছায়া তদন্ত করাকালেই ১৩ মার্চ ঢাকা থেকে মোসাব্বিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। ই-মুভি প্ল্যানের প্রতারণার সঙ্গে সন্দেহভাজন জড়িত হিসেবে ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মোসাব্বিরকে ঢাকার আদালতে তুলে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালতে তার রিমান্ডেরও আবেদন করা হয়েছে। তবে শুনানি হয়নি। এরমধ্যেই পরে চন্দ্রিমা থানা পুলিশ মোসাব্বিরকে ই-মুভির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা জানান, গত ৭ জানুয়ারি পাঁচ তারকা হোটেল ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে ই-মুভি প্ল্যানের সারা দেশের এজেন্ট ও বড় বড় বিনিয়োগকারীকে নিয়ে যে সম্মেলন হয়েছিল তার আয়োজন করেছিলেন আসামি মোসাব্বির হোসেন। অনুষ্ঠানের জন্য তিনিই হোটেল বুক করেছিলেন। এই সম্মেলনে চারজন চীনা নাগরিক এসেছিলেন। এদের তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। সেখানে নিজেদের ই-মুভির ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিচয় দিয়েছিলেন ব্রায়ান জন ও মিস্টার মাইকেল নামের দুজন। এদের সঙ্গে মোসাব্বিরের পরিচয় এবং প্রতারণার বিষয়ে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তা।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে গুগল প্লে স্টোরে চীনা অ্যাপ ই-মুভি প্ল্যান অ্যাপ দেওয়া হয়। অ্যাপে গ্রাহক হয়ে বিদেশি সিনেমার টিকিট কিনে রাখলেই পাওয়া যাচ্ছিল লভ্যাংশ। বিনিয়োগ-লাভের সব হিসাব ছিল মার্কিন ডলারে। অ্যাপে জমা রাখা ডলার লাভ-আসলে এক মাসেই বেড়ে দ্বিগুণ থেকে ৩৬০ গুণ পর্যন্ত হচ্ছিল। মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ কিংবা নগদের মাধ্যমে এই অ্যাপে বিনিয়োগ করা যাচ্ছিল। আবার এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই লাভের টাকা তোলা যাচ্ছিল। বিনিয়োগের পর কেউ লাখ, কেউবা হাজার হাজার ডলারের মালিক বনে গিয়েছিলেন। তা দেখে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ এতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। বাদ যাননি নারীরাও। কিন্তু গত ফেব্রæয়ারির শুরু থেকেই আর অ্যাপের ডলার ভাঙিয়ে টাকা তোলা যাচ্ছিল না। ১২ ফেব্রæয়ারি সব গ্রাহকের হিসাব শূন্য করে অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এ বিষয়ে নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরমধ্যে গত ১৯ ফেব্রæয়ারি জুয়েল রানা টিটু (২৭) নামের এক প্রতারিত গ্রাহক রাজশাহী মহানগরীর চন্দ্রিমা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। তাঁর বাড়ি শহরের পবা নতুনপাড়া মহল্লায়। মামলায় ই-মুভি প্ল্যানের রাজশাহীর এজেন্ট আজমল হুদা মানিক (৩৬) ও তার দুই সহযোগী মো. সিয়াম (৩৫) এবং এনামুল হককে (৪২) আসামি করা হয়। পুলিশ এদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
প্রধান আসামি আজমল হুদা মানিকের বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিলউথরায় গ্রামে। ই-মুভি প্ল্যানের কেলেঙ্কারীর পর থেকেই তিনি পলাতক। রাজশাহী নগরীর শিরোইল কলোনিতে ভাড়া নেওয়া বাড়িতে আজমল হুদার অফিস ছিল। সেটিও বন্ধ। এভাবে সারাদেশেই ই-মুভি প্ল্যানের এজেন্ট অফিসগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এজেন্টরাও এখন লাপাত্তা।
চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মাসুদ পারভেজ জানান, তারা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি। এরমধ্যেই সিআইডি ঢাকা থেকে এ বিষয়ে কাজ শুরু করে। সিআইডি এ বিষয়ে খুবই দক্ষ। তারা প্রথমে মোসাব্বিরকে ধরলে এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বৃহস্পতিবার মামলাটি সিআইডিকেই দেওয়া হয়েছে।
সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পুলিশ সুপার (এসপি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ই-মুভি প্ল্যানের এজেন্টরা বিকাশ কিংবা নগদের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাইনান্স থেকে ডলার কিনতেন। এরপর সেই ডলার পাঠিয়ে দিতেন ই-মুভি প্ল্যানের মূল হিসাবে। এভাবেই দেশ থেকে সহজ-সরল মানুষের টাকা পাচার হয়ে গেছে। তদন্ত শেষে তারা প্রতারিত মানুষের সংখ্যা এবং পাচার করা টাকার অংক বলতে পারবেন।