স্টাফ রিপোর্টার : সাড়ে সাত কিলোমিটারের একটি চারলেন সড়ক বদলে দিয়েছে নগরীর অর্থনীতি। সহজ করেছে যোগাযোগ ব্যবস্থার। বেড়েছে জমিসহ সম্পদের দাম। একই সাথে বিভিন্ন অবকাঠামো ও দোকানপাট নির্মাণের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের আলিফ লাম মীম ভাটার মোড় থেকে সড়কটি শুরু হয়েছে। শেষ হয়েছে চৌদ্দপাইয়ের বিহাস মোড়ে গিয়ে। প্রশস্ত সড়কটি গেছে বিভিন্ন এলাকার মধ্যে দিয়ে। এরমধ্যে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) চারটি ওয়ার্ডের কিছু কিছু অংশ পড়েছে। ৬ দশমিক ৭৯৩ কিলোমিটারের এই সড়কটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এনেছে আমূল পরিবর্তন। এক সময়ের ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি এবং বিল এলাকার মধ্যে দিয়ে যাওয়া প্রশস্ত সড়কের আধুনিক সড়কবাতির ঝলমল আলোয় মোহময় সৌন্দর্যে রূপ পেয়েছে। সড়কটি অর্থনীতি-সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের আলিফ লাম মীম ভাটার মোড় থেকে সড়কটি শুরু হয়ে শেষ হয়েছে চৌদ্দপায়ার বিহাস মোড়ে গিয়ে। সড়কটি রাসিক-এর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে শুরু হয়ে ১৯, ২৬ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যেই সড়কের দুইপাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। দোকানপাট, ব্যবস্থাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও আবাসিক এলাকা। এরমধ্যে আলিফ লাম মীম ভাটার মোড়ের দুই পাশে গড়ে উঠছে ডেভলপারদের বহুতলভবন। এই সড়কের দক্ষিণ পাশে ব্যাংক কলোনি গড়ে উঠেছে। এছাড়া ছোট বনগ্রাম ১২ রাস্তার মোড়ের অদূরে কাজী ফার্মের অফিস। তার কিছুদূওে একটি ড্রিংস কোম্পানির গোডাউন। নাদের হাজীর মোড়ে বেশ কিছু দোকানের সাথে গড়ে তোলা হয়েছে মধ্যমমানের খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। সেখানে বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে খাবার প্রেমিদের আনাগোনা।
অন্যদিকে, মেহেরচন্ডীর দায়েরা পার্ক মোড়ে খাবার হোটেল, হার্ডওয়্যার, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন দোকানপাট গড়ে তোলা হয়েছে। পশ্চিম বুধপাড়ায় সড়কের পাশে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ঢালাই মিকস্ট কারখানা। বুধপাড়া ও মোহনপুরের মাঝে ফ্লাইওভারের দুই পাশে খাবার হোটেল ও ছোট ছোট দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। দোকানগুলোতে বিকেলে পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। এই দোকানগুলো সড়ক হওয়ার আগে ছিল না। সড়ক নির্মাণের পরেই একবছরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করে দোকানগুলো তৈরি করা হয়েছে। এতে করে অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। একই সাথে একসময়ে ঝিমিয়ে যাওয়া বাররাস্তার মোড়, মেহেরচন্ডি দায়েরা পার্ক মোড় ও বিহাস গেট মোড় আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাহিদ জানান, এই সড়কটি তৈরি হওয়ার ফলে মানুষের যোগাযোগ সহজ হয়েছে। আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হলে গোরহাঙ্গা রেলগেট, ভদ্রা, তালাইমারী, কাজলা ঘুরতে হত। এতে যাতায়াত ব্যয়ের সাথে সময় নষ্ট হত। এখন সময় ও ভাড়া দুটিরই সাশ্রয় হয়েছে। একই সাথে সড়কের দুইপাশের জমির দাম বেড়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে সড়কের দুই পাশে দোকানপাট করে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর রাজশাহী-নওগাঁ প্রধান সড়ক হতে মোহনপুর-রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়। সড়কটি রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের আলিফ লাম মীম ভাটার মোড় হয়ে ছোট বনগ্রাম, মেহেরচন্ডী, বুধপাড়া, মোহনপুর হয়ে চৌদ্দপায়া রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমমুখি ৬.৭৯৩ কিলোমিটার ৪ লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় রেলওয়ে ক্রসিং এর উপর র্যামসহ ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। ২০২ দশমিক ৫০ মিটারের ফ্লাইওভার এবং ১২০ মিটার দৈর্ঘ্য এর র্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমে একটি ফ্লাইওভার করা হলেও প্রয়োজনের তাগিদে পরবর্তিতে পাশ দিয়ে আরো একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়াও সড়কের দুই পাশে ফুটপাথ, ১টি ব্রিজ, ৮টি কালভার্ট, মিডিয়ান ও ট্রাফিক কাঠামো ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আমার দুই হাত কাটা পড়ে। তার পরে দীর্ঘদিন বেকার ছিলাম। দুর্ঘটনার চার থেকে পাঁচ বছর পরে এই সড়কের কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ হওয়ার এক বছরের মাথায় হার্ডওয়্যারের দোকান দিই। দোকানে বাবা ও ছেলে (স¤্রাট) বসি। দোকানের উপর তলায় বাড়ি নির্মাণ করেছি। ফলে বাড়িতেই বসে হার্ডওয়্যার সামগ্রী কেনা বেচা করতে পারি। আল্লাহর রহমতে দোকান ভালোই চলেছে বলে জানান তিনি।
নগরীর মেহেরচন্ডী এলাকার বাসিন্দা আবির হোসেন বলেন, এই সড়কটা হওয়ার পরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জমির দাম। যে জমি ১ লাখ টাকায় কাঠা দওে কিনতে চায়নি এখন সেই জমি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা কাঠায় বিক্রি হচ্ছে। অনেকেই আরো দাম বাড়ার আশায় বিক্রি করছেন না। এই সড়কের দুই পাশে শতাধিক দোকান তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো থেকে মানুষ রীতিমত জীবিকা নির্বাহ করছেন। এছাড়া হয়েছে রেস্টুরেস্ট ও খাবারের দোকান। দোকানগুলোতে এই এলাকার ছাড়াও আশেপাশের মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসে।
নাদের হাজির মোড় এলাকার ধান চাষী সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, যখন সড়ক ছিল না। তখন ধান কেটে মাথায় করে ছোট সড়কের ধারে নিয়ে এসে ফেলতে হতো। এতে করে কষ্টের শেষ ছিল না। অভাবে জমি বিক্রি করবো মনে করলে মানুষ নিতে চাইতো না রাস্তা-ঘাট নাই বলে। কিন্তু এখন মানুষ জমি কিনতে চাই বাইপাস সড়ক হওয়ার করণে। আমরা বলি জমি বিক্রি করবো না। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। আগামিতে আরো দাম বাড়বে।
এ বিষয়ে রাসিক-এর ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পিন্টু বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মাননীয় মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামন লিটন চাচ্ছেন এই শহরকে আরো সুন্দর করতে। তার বেশিকিছু পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ, সড়ক প্রশস্তকরণ, ড্রেন নির্মাণের কাজ। এই সড়কটি হওয়ার ফলে মানুষের জীবমানের উন্নয়ন হয়েছে। একই সাথে এলাকাগুলোর গুরুত্ব বেড়েছে। যোগাযোগ সুবিধা উন্নত হয়েছে। জমির দামের পাশাপাশি অনেক মানুষের জীবন জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ঘিরে।
এ বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামন লিটন বলেন, সবসময় চেয়েছি রাজশাহীকে আধুনিক ও সুন্দর করে রাখতে। বিভিন্ন সড়ক নির্মাণ, প্রশস্ত করা হয়েছে। একই সাথে সড়কের পাশে প্রশস্ত ফুটপাত ও ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। যেন ফুটপাতে গাছের ছাঁয়ায় মানুষ স্বাছন্দে চলাফেরা করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, নগরীর বেশ কয়েকটি সড়কে রাজকীয় সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো রাজশাহী নগরীর মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যা দেখে দেশ ছাড়া বিদেশিরাও প্রসংশা করে। আলিফ লাম মিম ভাটার মোড় থেকে চৌদ্দপায়ের বিহাস পর্যন্ত চার লেনের সড়কে প্রথমে একটি ফ্লাইওভার ও পরে যানহন চলাচলের সুবিদার্থে আরো একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। যার নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। কাজ শেষ হলে শহরের যানজট আরো কমে যাবে।