• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  • somoyerkotha24news@gmail.com
  • +880-1727-202675

বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকতে হবে

প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ২:৫১

বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকতে হবে

আবহাওয়া ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই ধান চাষের জন্য খুব উৎকৃষ্ট জায়গা। পুরো বাংলাদেশ জুড়ে ধান চাষ হয়। সারা বছর জুড়ে নানা জাতের ধান হয়। কৃষকরা ধীরে ধীরে দেশীয় জাত থেকে সরে এসে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ধান চাষ বাড়ানোর কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চার কোটি ছয় লাখ টন চাল উৎপাদন করেছে। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় চার দশমিক এক শতাংশ বেশি।দেশে বার্ষিক মোট চালের চাহিদা কম-বেশি চার লাখ মেট্রিক টন। চালের হিউম্যান কনজাম্পশন (সরাররি ভাত) আছে। এছাড়াও নন – হিউম্যান কনজাম্পশন আছে। ১৫-২০ শতাংশ চাল নন-হিউমান কনজাম্পশনে ব্যয় হয়। বিগত কয়েক দশকে দেশের সকল ক্ষেত্রে খাদ্য উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাথমিকভাবে খাদ্যের জোগান আসে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ এই তিনটি উৎস থেকে। এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও এবং বিগত বছরগুলোতে গবেষণায় উদ্ভাবিত নতুন নতুন উন্নত জাত ও উৎপাদন পদ্ধতির প্রযুক্তিগুলো কৃষক বা খামারিদের মাঝে পৌঁছে দেয়ার ফলে দৃশ্যমান ফসল, ফল, শাকসবজি, প্রাণী ও মৎস্যের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার মাত্রা প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ২য়, ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মাছ উৎপাদনে ৩য়, ইলিশ উৎপাদনে ১ম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে ২য়, ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে ৪র্থ, গবাদি পশু উৎপাদনে ১২তম।

বাংলাদেশে মৌসুম অনুযায়ী প্রধাণত তিন ধরনের ধান চাষ করা হয়: আমন, আউশ এবং বোরো। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে । ২৩ জেলার ১৪.১৪ লাখেরও বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধানের উৎপাদনে।

আমনেরআবাদওবীজতলারযেপরিমাণক্ষতিহয়েছেতাথেকে৬লাখ৮৫হাজারমেট্রিকটনধানপাওয়াযেত। এর বাইরে প্রায় ১ লাখ সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন আউশ ধানের উৎপাদননষ্টহয়েছে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর ধান উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় হলেও এখানকার হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ৪.৫ টন। চীন, জাপান ও কোরিয়ায় এ ফলন হেক্টরপ্রতি ৬-৬.৫ টন। তবে চীন, জাপান ও কোরিয়ায় সারা বছরে একটি মাত্র ধান ফসল উৎপাদন হয়; অথচ বাংলাদেশে একই জমিতে বছরে তিন বার ধান উৎপাদন হয়। সে বিবেচনায় আমাদের ধানের ফলন অন্য দেশের চেয়ে কম নয়। তথাপি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ধানের ফলন আরও বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সনাতন জাতের ধান এবং মান্ধাতার আমলের আবাদ পদ্ধতির মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান ও আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলন। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে তা মোকাবিলার জন্য ক্লাইমেট স্মার্ট/ঘাত সহনশীল প্রযুক্তি উদ্ভাবন একান্ত জরুরি।
দেশে সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে শুষ্ক মৌসুমেও ধান চাষের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিশেষ মৌসুমটি বোরো মৌসুম নামে পরিচিত। বোরো ধানের চারা সাধারণত নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু ফেব্রুয়ারির মধ্যে রোপণ করা হয় এবং এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ফসল কাটা হয়। বোরো ধান প্রধাণত তিন ধরনের হয়,স্থানীয় বোরো, উচ্চফলনশীল জাতের বোরো এবং হাইব্রিড বোরো। বর্তমানে, বোরো ধানই দেশের প্রধান ধান উৎপাদন মৌসুম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশে বোরো ধান উৎপাদন হয় কম-বেশি ১২০ লাখ একর জমিতে । আর বোরো ধানের চাল উৎপাদন হয় কম বেশি ২কোটি ৭ লাখ মেট্রিক টন।

উচ্চফলনশীল জাতের বোরো ধান উৎপাদনে সেচ, সার এবং অন্যান্য ব্যয়বহুল উপকরণের ব্যাপক ব্যবহার প্রয়োজন হয় যা এটিকে তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল করে তোলে। তবে সবুজ বিপ্লবের পর থেকে উচ্চ ফলনশীলতার কারণে এই জাতের বোরো ধান ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক এবং খাদ্য নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে বোরো ধান এখন দেশের চাল উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য হয়।

বোরো মওসুমের জাতগুলোতে কোনো আলোক-সংবেদনশীলতা নেই। এ মওসুম শুরু হয় ঠান্ডা ও ছোটো দিন দিয়ে, আর ফুল ফোটে গরমের শুরুতে এবং বড়ো দিনে। তাই আলোক-সংবেদনশীল কোনো ধানের জাত বোরো মওসুমে আবাদ করা উচিত নয়। বোরো মওসুমের যে সমস্ত জাতের জীবনকাল ১৫০ দিন বা তার চেয়ে কম সে জাতগুলোর বীজ বপন করতে হয় অগ্রহায়ণ মাস শুরু হলে এবং যে জাতগুলোর জীবনকাল ১৫০ দিনের চেয়ে বেশি সেগুলো ২০ কার্তিক থেকে বীজ বপন করা যাবে। উল্লিখিত সময়ে বীজ বপন করলে চারার উচ্চতা ভেদে ৩৫-৪৫ দিনের চারা রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। বোরো ধানের রোপণ ১৫ মাঘের মধ্যে শেষ করা উচিত। এরপর রোপণ করলে জীবনকাল ও ফলন দুইই কমে যায়। ধান গাছের জীবনচক্রের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায় ও ধাপে সঠিক সময়ে কার্যকর কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধান গাছের জীবনচক্রে বীজের অঙ্কুরোদ্গম থেকে ধানের পরিপক্ব অবস্থা পর্যন্ত তিনটি বৃদ্ধি পর্যায় অতিক্রম করে থাকে। অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায়, প্রজনন পর্যায় ও পরিপক্ব পর্যায়। অঙ্গজ বৃদ্ধি পর্যায় ধানের অঙ্কুরোদ্গম থেকে সর্বোচ্চ কুশি পর্যায় পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সময়ে গাছের সবচেয়ে বেশি যত্ন প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বোরো ধানের কম বেশি ২৭ টি জাত উদ্ভাবন করেছে। বিআর-১, বিআর-৬,ব্রি ধান-২৮,ব্রি ধান-৪৫,ব্রি ধান-৭৪,ব্রি ধান-৮১,ব্রি ধান-৮৪,ব্রি ধা-৮৬,ব্রি ধান-৮৮,ব্রি ধান-৯৬,ব্রি হাইব্রিড ধান-২,ব্রি হাইব্রিড ধান-৩,ব্রি হাইব্রিড ধান-৫,ব্রি হাইব্রিড ধান-৮ এগুলো সবই উচ্চ ফলনশীল এবং সকল ধানের জীবনকাল ১৫০ দিনের কম । ব্রি ধান৮১ জাতের গাছের কান্ড ব্রি ধান২৮-এর চেয়ে শক্ত ও পাতা সামান্য হেলানো। ধানের রং খড়ের মত, ধানের আকৃতি লম্বাও চিকন এবং অগ্রভাগ জিরার মতো সামান্য বাঁকানো, ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন ২০.৩ গ্রাম, । এ জাতের জীবনকাল ১৪০-১৪৫দিন। এ জাতের ফলন ক্ষমতা হেক্টরে ৬.০-৬.৫ টন। ব্রি ধান৮৬ অ্যান্থার কালচার পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত বোরো মওসুমের জাত। এ জাতের গাছের কান্ড ব্রি ধান২৮ এর চেয়ে খাটো ও শক্ত তাই ঢলে পড়ে না। দানা লম্বা চিকন ও দানার মাথা সামান্য বাঁকা, ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.৮ গ্রাম, অ্যামাইলোজ ২৫%, ভাত ঝরঝরে ও উচ্চ মাত্রার প্রোটিন (১০.১%) সমৃদ্ধ। ব্রি ধান৮৮ এ আধুনিক উফশী ধানের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অঙ্গজ অবস্থায় গাছের আকার ও আকৃতি ব্রি ধান-২৮ এর চেয়ে খাটো। এ জাতের পাতা খাড়া এবং লম্বা। ধানের দানা অনেকটা ব্রি ধান-২৯ এর মত তবে সামান্য চিকন। পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ১০০ সেমি। এ জাতের জীবনকাল ১৪০-১৪৩ দিন, ফলন ক্ষমতা ৭.০ টন/হেক্টর। ১০০০টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২২.১ গ্রাম। পাকা ধানের রং খড়ের মত। চালের আকার আাকৃতি মাঝারি চিকন ও ভাত ঝরঝরে। । ব্রি ধান-৯৬-এর পূর্ণবয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ৮৭ সেমি, পাতা খাড়া ও লম্বা। দানা মাঝারি-মোটা এবং দানার রং স্বর্ণা ধানের মত লালচে, ১০০০টি পুষ্ট দানার ওজন প্রায় ১৮.৪ গ্রাম, রান্নার পর ভাত ১.৬ গুণ লম্বা হয়। ব্রি ধান-৯৬ এর জীবনকাল মেগা জাত ব্রি ধান-২৮ এর মত, ১৪০-১৪৫ দিন, গড় ফলন ৭.০ টন/হেক্টর, তবে উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ৮.৬ টন/ হেক্টর পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম। এ জাতের গাছ খাটো ও গোড়া শক্ত হওয়ার কারণে ঢলে পড়ে না বিধায় যান্ত্রিকভাবে ফসল কর্তনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। ব্রি হাইব্রিড ধান-৩ বোরো মওসুমের ১৪৫ দিন জীবনকাল সম্পন্ন একটি আগাম জাত। পরিপক্ক অবস্থায় এর কান্ড শক্ত ও মজবুত থাকায় গাছ সহজে হেলে পড়েনা। প্রতি হেক্টরে জাতটির গড় ফলন ৮.৫-৯.০ টন। মাঝারি জীবনকাল হওয়ায় এ জাতটি ব্রি ধান-২৮ এর পরিপূরক হিসেবে চাষাবাদ করা যায়। চাল মাঝারি মোটা ও ভাত ঝরঝরে। ব্রি হাইব্রিড ধান-৫ বোরো মওসুমের জন্য ১৪৩-১৪৫ দিন জীবনকাল সম্পন্ন স্বল্পমেয়াদি ও অধিক ফলনশীল একটি হাইব্রিড ধানের জাত। ফলন ৮.৫-৯.৫ টন/হেক্টর। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ধান উৎপাদনে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুশিয়ে নেওয়ার জন্য বোরো উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট সকলকে মনোযোগী হতে হবে। আউশ এবং আমন ধানের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। চালের দাম বৃদ্ধি কিছুটা পেয়েছে।চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে দেশে বোরোর উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।

ইমদাদ ইসলাম (পিআইডি ফিচার)

সর্বশেষ সংবাদ

 

রাজনীতি-এর আরও সংবাদ

 



সম্পাদক ও প্রকাশক : ইয়াকুব শিকদার

ঢাকা অফিস: ১২১,ডি.আই.টি, এক্সটেনশন রোড, ফকিরাপুল, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০। রাজশাহী অফিস: বহরমপুর (সিটি বাইপাস), জিপিও-৬০০০, রাজপাড়া, রাজশাহী। ই-মেইল: somoyerkotha24news@gmail.com, মোবাইল: 01727202675