রাবি প্রতিনিধি : সালটা ছিল ২০০৮। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম হন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু এই প্রথম হওয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় রফিকের জীবনে। ভালো ফলাফল করায় শিবির সন্দেহে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফলিত গণিত বিভাগ থেকে তাকে তুলে নিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। দীর্ঘ ৪ মাস ৭ দিন কারাবরণ করতে হয়েছিল তাকে।
জেলখানা থেকে দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সেখানেও প্রথম হোন এই মেধাবী শিক্ষার্থী। এভাবেই নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অনার্সে ৩.৮০ পেয়ে বিভাগে প্রথমস্থান অর্জন করেন। রফিকুলের স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেননি বিভাগের তিন শিক্ষক। মাস্টার্সের থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ এনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশ করা হয়নি রফিকুলের মাস্টার্সের ফলাফল।
অবশেষে, গত ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের ৫৩৬তম সভায় ১০ বছর ৬ মাস পরে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ছোট থেকেই তুখোড় মেধার অধিকারী ছিলেন রফিকুল ইসলাম। স্কুল-কলেজের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ফলিত গণিত বিভাগে।
জানা যায়, রাবিতে মাস্টার্সে বাধার সম্মুখীন হওয়ায় ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন। সেখানে সিজিপিএ ৪.০০ পেয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তী সময়ে, ২০২৪ সালে চীনের ডালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনার্সে প্রথম স্থান অর্জন করে ২০১৪ সালে বিভাগের তৎকালীন সভাপতি বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সরকারের অধীনে মাস্টার্সের থিসিস নেন তিনি। এদিকে ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট ফলিত গণিত বিভাগে ২ জন প্রভাষক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সার্টিফিকেট দেখিয়ে রফিকুলও এ নিয়োগে আবেদন করেন।
কিন্তু নিয়োগ বোর্ডে মাস্টার্সের সনদ দেখাতে হবে বলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। এ সময় রফিকুলের থিসিস সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে সিলগালা প্যাকেট খুলে নম্বরপত্র টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুল হক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফলাফল প্রকাশ স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. ফজলুল হক বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার মৌখিক ও লিখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সকল তথ্য উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে রিভিউ তদন্তের কাজ শেষ করা হয়েছে। বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মাঈন উদ্দিন খান বলেন, রফিকুল বিভাগের ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট ছিলেন। শিক্ষক নিয়োগে যেন আবেদন করতে না পারে সেই জন্য থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ এনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়। যার কোনো সত্যতাই ছিল না। এ নিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট এক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩৬তম সিন্ডিকেট সভায় নিয়মানুযায়ী রফিকুল ইসলামের মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উল্লেখ্য, মাস্টার্সের থিসিস জালিয়াতির অভিযোগে এনে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬১তম সিন্ডিকেটে ১৩৭নং সিদ্ধান্তে মাস্টার্সের রেজিস্ট্রেন বাতিলের মাধ্যমে রফিকুলের ছাত্রত্ব বাতিল করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসন।