• ঢাকা, বাংলাদেশ
  • ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
  • নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল
  • somoyerkotha24news@gmail.com
  • +880-1727-202675

পথশিশুর পুষ্টি এবং বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ

প্রকাশ: রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ২:১৬

পথশিশুর পুষ্টি এবং বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ

বাংলাদেশের বাবা-মায়েরা সন্তানের জন্য দুধে-ভাতে ভরপুর জীবন কামনা করেন। যে শিশুর জন্মের পর নিজের বাবা-মা, বলতে গেলে সবচেয়ে কাছের স্বজনরা যার ঠিকানা বানিয়ে দেয় রাস্তা, মরে যাওয়া যার জন্য স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে থাকে যে শিশু, তাকে ‘পথকলি’ নামে আল্লাদ করে কখনো কখনো ডাকা হলেও আপাদমস্তক যে শিশু পথশিশু, দুনিয়ার সবচেয়ে হতভাগা বললেও কম বলা হয় যাকে, তার জন্য দুধ-ভাত তো দূরের কথা, দু’ মুঠো ভাতের নিশ্চয়তাই সে পায় না। টিকটক ভিডিওতে দেখছিলাম, পলিথিনে মোড়া ডান্ডি খেয়ে ঝিমুতে থাকা নেশাগ্রস্ত এক পথশিশু বলছে, ‘এইডা খাইলে খিদা লাগে না’। যে রাষ্ট্র এবং সমাজ যার কাছে ভাতের চেয়ে কম দামে নেশাকে সহজলভ্য করে উপস্থিত করে, সেই রাষ্ট্র এবং সমাজ আমরা চাই না। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া প্রতিটি শিশুর অমূল্য জীবনের বিনিময়ে আমরা যে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ পেয়েছি, তা নিশ্চিতভাবে হাতছাড়া হবে যদি না এই দেশ পথশিশুর মুখে পুষ্টিকর খাদ্য তুলে দিতে না পারে।
দেশের পথশিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ অক্টোবর দেশে পালিত হয় পথশিশু দিবস। নিয়ম মেনে আলোচনা-বর্ক্তৃতা-গান-নাচ আর প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুটলেও কোনো পরিবর্তন আসে না দেশের আনুমানিক ৪০ লাখ পথশিশুর জীবনে। সারা দেশের পথে দেখা মেলে হতভাগাদের। এদের শতকরা ৭৫ ভাগই বাস করে রাজধানী ঢাকায়। সেই বাস কীরকম, ভাবতেও ভয় করে। দিনরাত পথে আছে, অথচ বসার জায়গা নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে রাস্তা পার হয়, কেউ দেখার নেই। ২০১৬ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার পথশিশুদের মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ শিশুর রাতে ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসলহীন অবস্থায় থাকে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার মতো কোনো স্বজন নেই, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে ও ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থতায় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারে না। কনসোর্টিয়াম ফর স্ট্রিট চিলড্রেন, কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশন, লিডো, গ্রাম বাংলা উন্নয়ন কমিটি ও আহসানিয়া মিশনের এক সমন্বিত গবেষণায় উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশুই পুরোপুরিভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ক্ষুধার তাগিদে তারা গড়ে ১০ ঘণ্টা কাজ করে এবং ৩৫ শতাংশ পথশিশু ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সব ধরনের অধিকারবঞ্চিত কত পথশিশুকে বড়ো মানুষরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত করছে, সে হিসেব এখনো পাইনি। তবে, অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ভাবতে কষ্ট হয়।
লাল গোলাপ হাতে যে শিশুটি ভদ্রলোকদের প্রাইভেট কারের জানালায় ঝুঁকে বলছে ফুল কিনতে, ওর সাথে ভালো ব্যবহার করার স্বভাব গাড়ির ভেতরে বসে থাকা ভদ্রলোকদের কম। শিশুটির মনের আর পেটের খবর নেয়ার ‘ঝুঁকি’ কেউ নেয় না। ওদের খাবার ওদেরকেই কিনে খেতে হয়, কাউকে কাউকে পরিবারের অন্য সদস্যদেরকেও খাওয়াতে হয়। উপার্জন করতে না পারলে ওরা খাবার কিনতে পারে না। বড়োদের সমান খাটুনির পরও ওকে মজুরি কম দেয় বড়ো মানুষরা, উপার্জন সঙ্গতকারণেই কম করতে পারে বলে ভদ্রলোকের সন্তানদের মতো ভাতের সাথে দুধ কেনার সামর্থ্য ওর থাকে না। দুধে-ভাতে পেট ভরানোর কপাল ওর না। কম দামে যা দিয়ে পেট ভরানো যায়, তা-ই কিনে খায় ও। সে খাবারে পুষ্টি কতটুকু, সেই সচেতনতাবিষয়ক জ্ঞান ওকে কেউ দেয়নি। ওরও ফুরসত নেই পুষ্টি নিয়ে ভাবার। এর সাথে আছে মাদকের নেশা। খিদের অনুভূতিকে ফাঁকি দেওয়ার বুদ্ধিতে ভাতের চেয়ে কম দামে কেনে মাদক। অসুখ হলে যত্ন পায় না, ওষুধ কেনা হয় না। ওরা তাই কম বয়সে মরে যায়, আর বিষয়টা এতটাই স্বাভাবিক যে খবরের পাতায় ঠাঁই হয় না সে সংবাদ।
বাংলাদেশের সকল স্তরের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে, সাড়ে তিন লাখ শিশু ভুগছে তীব্র অপুষ্টিতে। ফলে বাংলাদেশের শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে বিধায় মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। ঢাকা শহরের বস্তিতে তো বটেই, এমনকি লন্ডনে অভিবাসী হয় যে বিভাগের মানুষ সবচেয়ে বেশি, সেই সিলেটেও খর্বকায় শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক হারে বেশি। ১১ শতাংশ শিশু কৃশকায়। আর ৪ শতাংশ হলেই দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা জরুরি হয়ে পড়বে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলে পথে নামুন। রাস্তায় পলিথিন বিছিয়ে ভাত-তরকারি মাখিয়ে খাবার, ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া খাবার, রেস্টুরেন্টের ফেলে দেওয়া খাবার খেতে ব্যস্ত পথশিশুদের দেখতে পাবেন। ভদ্রলোকের সন্তানদের মতো এটা খাবো না, সেটা খাবো না বায়না করার সুযোগই নেই ওদের।
মেয়ে পথশিশুরা বিয়ের মাধ্যমে অথবা ধর্ষণের ফলে শিশু জন্ম দেয়। পথশিশুর সন্তান পথশিশুই হয়। গর্ভবতী অবস্থায় চরম অপুষ্টির শিকার মেয়েটি জন্ম দেয় অপুষ্ট শিশুর। এই চক্র থেকে বের হওয়ার যেন কোনো উপায় নেই। আসলেই, দারিদ্র বা খাদ্যের অনিশ্চয়তা পথশিশুদের অপুষ্টির একমাত্র কারণ নয়। পথশিশুদের প্রতি রাষ্ট্র-সমাজ, আপনার আমার মায়া-মমতা এবং ওরাও দেশের ভবিষ্যৎ বলে ওদেরকে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা জরুরি- এই সচেতনতা খুব জরুরি। কত শিশু পথশিশু হয়ে জীবন কাটাচ্ছে, তার পরিসংখ্যান সরকারের কাছে থাকা জরুরি। প্রতিটি শিশুর জরুরি তথ্যসম্বলিত ডাটা বেইজ দাঁড় করানো জরুরি। এই পরিসংখ্যান ও ডাটা বেইজ প্রতি বছর আপডেট করা জরুরি। শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পথশিশুদের জন্য ‘মিল্ক ব্যাংক’ তৈরির চেষ্টা করছে বলে পত্রিকার খবরে দেখেছি। পথশিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম’ পরিচালনা করছে, সমাজ সেবা অধিদপ্তর পথশিশুদের জন্য শেল্টার হোম পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মাধ্যমে ঢাকার আজিমপুরে মেয়ে পথশিশুদের জন্য এবং ছেলে শিশুদের জন্য কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরে ১টি করে ৩টি কেন্দ্রসহ মোট ৬টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উন্মুক্ত স্কুলসহ তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে দুঃস্থ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তবে পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব এবং সেই বাজেটও দুর্নীতির ফলে আরও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ায় বিগত সরকারের সময় পুনর্বাসন কার্যক্রম নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। শেল্টার হোমের নোংরা পরিবেশে শিশুরা থাকতে চায় না, অনেকে পালিয়ে গিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে।
সরকারের পাশাপাশি কয়েকটি এনজিও এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে পথশিশুদের রাতে থাকার জন্য কিছু শেল্টার হোম গড়ে উঠেছে। ওদেরকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য ভ্রাম্যমাণ স্কুল আছে। খাবার, পোষাক দেওয়ারও চেষ্টা করছেন অনেকে। এসব উদ্যোগের ব্যাপকতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পথশিশুদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে পারে। পথশিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রতি বছর ফ্রি স্বাস্থ্য ক্যাম্প, ভ্যাকসিনেশন, চিকিৎসা সুবিধা দিতে সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি এনজিওরাও এধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পথশিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে পথশিশুদের পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন করা যেতে পারে। বিভিন্ন সংগঠন বা স্কুলগুলি পথশিশুদের শিক্ষা এবং পুষ্টি সম্পর্কিত বিষয়ে সহায়তা করতে পারে। কমলাপুর পথশিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতি প্লেটে এক পিস ছোট শিং মাছ আর পাতলা ডাল দেওয়া হয় বলে খবর হয়েছিল। বাজেটের ঘাড়ে দোষ চাপানো হলেও দুর্নীতির করালগ্রাসে শিশুদের অধিকার খেয়ে ফেলা বড়ো মানুষদের দৌরাত্ম্য আমরা আর দেখতে চাই না। পথশিশুদের হাতে পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। আন্তরিকভাবে পথশিশুদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা গেলে কী দারুণ ঘটনাই না ঘটবে!
বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে নিশ্চয়ই একটি শিশুও রাস্তায় জীবন কাটাবে না। এদেশে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশু ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-শ্রেণি নির্বিশেষে দেশের ভবিষ্যৎ। তাই প্রতিটি শিশুর নিশ্চিন্ত জীবন নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে, এমন বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।

লেখিকা: নাসরীন মুস্তাফা
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, ঢাকা
পিআইডি ফিচার

সর্বশেষ সংবাদ

 

রাজনীতি-এর আরও সংবাদ

 



সম্পাদক ও প্রকাশক : ইয়াকুব শিকদার

ঢাকা অফিস: ১২১,ডি.আই.টি, এক্সটেনশন রোড, ফকিরাপুল, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০। রাজশাহী অফিস: বহরমপুর (সিটি বাইপাস), জিপিও-৬০০০, রাজপাড়া, রাজশাহী। ই-মেইল: somoyerkotha24news@gmail.com, মোবাইল: 01727202675