স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে গত ১৩ মার্চ পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিকে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তবে গত ২১ মার্চ নির্ধারিত সময় পার হয়ে আরও ৬ কার্যদিবস অতিবাহিত হলেও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত কমিটি। কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা হবে সেটিও অনিশ্চিত। এনিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা বলছেন, ‘রিপোর্ট প্রদান নয়, উত্তেজনা প্রশমনের জন্যই এসব কমিটি গঠন করা হয়।’
এর আগে, গত ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাস সুপারভাইজারের কথা কাটাকাটির জের ধরে বিনোদপুর বাজারে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। পরে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা গেলে স্থানীয়রা তাদেরকে ধাওয়া করে। পরে বিষয়টিকে সাধারণ শিক্ষার্থীর ওপর স্থানীয়দের হামলা বলে প্রচার করা হয়ে শিক্ষার্থীরা এতে জড়িয়ে পরে। অপরদিকে বিনোদপুর বাজারের ব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নেন বিনোদপুরের স্থানীয়রা। এতে আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয় ও একটি পুলিশ বক্স ও রাস্তার ধারের অন্তত ১০টি দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছররা গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। দুইদিন ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ঘটনার প্রতিবাদে ১২ মার্চ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা চারুকলা সংলগ্ন রেললাইন ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ করে সড়ক অবরোধ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা করে।
সংঘর্ষের দুই দিন পর ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হুমায়ুন কবীরকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর তারিকুল হাসান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রশিদ সরকার ও সিন্ডিকেট সদস্য মো. শফিকুজ্জামান জোয়ার্দ্দার।
প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। যাদের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম তাদের অনেকের কাছেই পৌঁছাতে পারছিলাম না। ফলে কয়েকদিন বেশি লেগে গেছে। আর রোজার কারণে আরও বিলম্ব হচ্ছে। তবে আমাদের রিপোর্ট লেখালেখির পর্যায় চলছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই জমা দিতে পারবো।’
কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে সহ-উপাচার্য বলেন, ‘কবে জমা দিতে পারবো সেটি নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কারণ এটা তো আমার একার হাতে না। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিবেদন জমা দিয়ে শেষ করব।’
ঘটনাটিকে জাতীয় পর্যায়ে অস্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নাট্যজন মলয় ভৌমিক বলেন, ‘এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়ে অস্থিতিশীল করার প্রক্রিয়া। এই উপমহাদেশে অনেক ঘটনারই তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ঘটনার প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। এটি বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তবে দেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে এ ঘটনাটির একটি সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া ও সেই অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ খুবই জরুরী।’
তদন্ত কমিটি গঠনকে শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা প্রশমনের মাধ্যম উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, আমরা দেখি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এর রিপোর্ট শেষ পর্যন্ত কেউ জানতে পারে না। এতে কারো সুপারিশ থাকে কি না, দায়-দায়িত্ব কার থাকে আমরা সেটিও পরিষ্কারভাবে জানতে পারি না। এই ঘটনায়ও এমনটিই হওয়ার কথা। এই কমিটিগুলো সাধারণত একটা খারাপ পরিস্থিতিতে করা হয় যাতে শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা প্রশমন করা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, এর আগেও অনেক কমিটি গঠন হয়েছে কিন্তু কোনো প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী মেডিকেলে মার খাওয়ার ঘটনায়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিন্তু সে কমিটির প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে তারও কোনো রিপোর্ট আমরা পাইনি। আমরা তখনই বলেছি, তদন্ত কমিটি গঠন করা মানে বিষয়টিকে ‘ইগনোর’ করে যাওয়া। এত বড় একটা ঘটনা, এত শিক্ষার্থী রক্তাক্ত, তারপরেও যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত করতে ঢিলেমি করে এটা খুবই দুঃখজনক।
রাকসু আন্দোল মঞ্চের আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, এ ঘটনায় আমরা প্রশাসনের কাছে দ্রুত তদন্তের দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জোর দিয়ে বলেছে যে এই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে। তাই তারা ৭ কার্যদিবস সময় নিয়েছে। কিন্তু সেই ৭কার্যদিবসের পর আরও ৭দিন পেরিয়ে গেলেও তারা প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এতে প্রশাসনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় একই ধরনের অপরাধ বারবার সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীরা পার পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বারবার অপরাধ সংঘটিত করছে। ভুক্তভোগীরা আরও হতাশ হয়ে পড়ছে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও হুমকির মুখে পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার পিআরও কথা বলবেন। আমি টেলিফোনে ইন্টারভিউ করি না।’