স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর যখন যেখানে ফোন পাচ্ছেন, মোটরসাইকেলে চা নিয়ে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন মো. রনি আহম্মেদ। চা বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে দোয়াও চেয়ে নিচ্ছেন নিজের জন্য। মূলত করোনাকালে দোকান বন্ধ হওয়ার পর থেকেই তিনি এভাবেই চা বিক্রি করে আসছেন। চা বিক্রি করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছেন রনি। এবার জনগণের চাওয়াতেই ভোটরে মাঠে নেমেছেন তিনি। ভোটের মাঠে নেমেও ছাড়েনি চা ব্যবসা।
পবা উপজেলার দহপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলা এলাকার বাসিন্দা রনি আহম্মেদ। আগামী ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য পবার হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ সদস্য (মেম্বার) পদে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড থেকে ঘুড়ি প্রতীকে ভোট প্রার্থনাও শুরু করেছেন তিনি।
তবে ভোটের মাঠে রনির পদচারণা অন্য প্রার্থীদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তিনি পেশায় চা বিক্রেতা। এক সময় দোকানে পসরা সাজিয়ে আর দশজনের মতো চা-বিস্কুট বিক্রি করতেন তিনি। ভাগ্যের নির্মমতায় করোনা মহামারীর সময় বন্ধ হয়ে যায় দোকানের বেচাবিক্রি। সেই থেকে মোটরসাইকেলে করেই পথে পথে চা খাইয়ে বেড়ান রনি। টিকিয়ে রেখেছেন জীবন নৌকার হাল।
জানা যায়, সাত বছর বয়সে রনির মা মারা যান। দুই সন্তানকে রেখে বাবা বিয়ে করে অন্যত্র পাড়ি জমান। রনি ও তার বোনের ঠাঁই হয় নানির সংসারে। নানাও মারা গিয়েছিলেন বেশ আগেই। সংসার চালাতে শিশু বয়সে বাদামের ঝুড়ি হাতে তুলে নেন রনি। কিছুটা বড় হয়ে ভ্যান চালাতে শুরু করেন। বিয়ের পর স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে আর্থিক অনটনে পড়েন। বছর আটেক আগে বাড়ির পাশে তেঁতুলতলা বাজারে ছোট একটি চায়ের দোকান দেন তিনি। যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চলে যেত।
করোনাকালে ২০২০ সালে রাজশাহীতে বিধিনিষেধ শুরু হলে চায়ের দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হন রনি। সংসার চালাতে দুই ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি শুরু করেন। তারপর ঋণ করে মোটরসাইকেলে চা বিক্রি শুরু করেন ওই বছর থেকেই। এতেই চলছে সংসার। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন ৪০০ কাপের মতো চা বিক্রি করেন। প্রতি কাপ মসলাযুক্ত রং চা ৫ টাকা আর ব্ল্যাক কফি, দুধ কফি ও দুধ চা ১০ টাকা করে বিক্রি করেন তিনি। আর চা বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন স্ত্রী রানু বেগম।
পবা উপজেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজার হরিয়ান কিংবা কাটাখালীই হোক না কেন, একটি মাত্র ফোন কলেই চা নিয়ে হাজির রনি। টাকা না থাকলেও হাঁসি দিয়ে চা তুলে দিয়েছেন গরীব ও অসহায়দের হাতে। এভাবেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছেন চা বিক্রেতা রনি। তাই জনগণের চাওয়াতেই এবার ভোটের লড়াইয়ে তিনি। ভোটের মাঠে নেমেও ছাড়েন নি চা ব্যবসা। নির্বাচনী প্রচারণার পাশাপাশি চলছে চা বিক্রিও।
সরেজমিনে জানা যায়, রনির মোটরসাইকেলের দুপাশে বড় বড় চারটি চায়ের ফ্লাস্ক ও পেছনের সিটে আরেকটি লোহার তৈরি বাক্সের মতো ফ্রেমে রাখা আছে ছোট ছোট প্লাস্টিকের কাপ, পানিসহ অন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আর মোটরসাইকেলের সামনে ও পেছনে সাঁটানো রয়েছে একাধিক নির্বাচনী পোস্টার। যেখানে লেখা রয়েছে, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্যপ্রার্থী মো. রনি আহম্মেদ। যখন যেখানে ফোনে ডাক পাচ্ছেন, মোটরসাইকেলে চা নিয়ে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন। চা বিক্রির সঙ্গে দোয়াও চেয়ে নিচ্ছেন নিজের জন্য।
রনি আহম্মেদ জানান, করোনার সময় তার চায়ের দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকেই শুরু করেন মোটরসাইকেলে করে চা বিক্রি। ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রির মাধ্যমে এলাকার মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন জনপ্রিয়। যে মানুষগুলো তার চা কেনেন তারাই তাকে ভোটে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনী খরচ যতটুকু হয়, তাতেও সহযোগিতা করছেন এলাকাবাসী। নির্বাচনী সেবা হিসেবে রনি শুধু মানুষকে চা খাওয়াচ্ছেন, সেই টাকাও অনেকে দিয়ে দিচ্ছেন।
রনি বলেন, আমার তেমন খরচ নেই। মানুষ আমাকে ভালোভাবেই চেনেন। তবুও ভোটের মাঠে মানুষকে চা খাওয়াচ্ছি। আমি ফ্রি চা খাওয়াতে চাই কিন্তু আনেকেই টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। আমি গরিবের পাশে ছিলাম। নির্বাচনে আমাকে মানুষ বিজয়ী করবে বলে আশা করছি। বিজয়ী হলেও আমি চায়ের ব্যবসা করবো। আমি যেহেতু গরিব। বিজয়ী হলে আমি গরিবদের পাশে দাঁড়াবো।
রনির চা খেতে খেতে ওই এলাকার বাসিন্দা মারুফ হোসেন বলেন, রনি চা বিক্রেতা হতে পারে, তবে তার মন অনেক বড়। এলাকার যে কারো বিপদে পাশে দাঁড়ান রনি। করোনার সময় যখন সবাই নিজের চিন্তায় ব্যস্ত, তখনও রনি আমাদের পাশে ছিলেন। টাকা না থাকলেও চা খাইয়েছেন। তিনি আমাদের পাশে ছিলেন, তাই আমরাও তার পাশে আছি।
মর্তুজা নামের এক নতুন ভোটার বলেন, রনি ভাই ব্যক্তি হিসেবে অনেক ভালো। অন্য প্রার্থীদের চেয়ে আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও তার মন বড়। ভালো কাজ করার মানসিকতা আছে। সবার কাছে পরীক্ষিত তিনি। আমরা তার পাশে আছি।
উল্লেখ্য, রনি ছাড়াও তার ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে আরও পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আগামী ১৭ জুলাই ইউনিয়নের ৯ ওয়ার্ডের ৯ কেন্দ্রে একযোগে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের মোট ভোটার সংখ্যা ১৯ হাজার ৫২৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ হাজার ৮৫০ জন ও নারী ভোটার ৯ হাজার ৬৭৮ জন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ছয়জন, সংরক্ষিত তিনটি নারী সদস্য পদে ১৯ জন এবং নয়টি সাধারণ সদস্য পদে ৫১ জনসহ মোট ৭৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।