শনিবার, মে ১৮, ২০২৪

নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল

আর ও খবর

বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে

সেলিনা আক্তার : সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের নারীদের বেশ কয়েকটি তাক লাগানো সাফল্য সবার দৃষ্টি কেড়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশের নারী বিজ্ঞানী ড. ফিরদৌসি কাদরির ২২তম ল’রিয়েল-ইউনেস্কো ফর ওমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন। তিনি আইসিডিডিআর’বির মিউকোসাল ইমুনোলজি অ্যান্ড ভ্যাকসিনোলজি ইউনিট অব ইনফেকসিয়াস ডিজিসেস ডিভিশনের প্রধান। ফিরদৌসি উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের সংক্রামক রোগ সম্পর্কে গবেষণার জন্য এই সম্মাননা পেয়েছেন।

মাহজাবিন হক নামের আরেক বাংলাদেশি নারী যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি । এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনাটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) অর্থায়নে পড়ালেখার পাশাপাশি নাসার নিজস্ব ল্যাবে রিসার্সের সুযোগ পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আদিবা সাজেদ । আমাদের মেয়েরা ফুটবল খেলে যখন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভালো করেছে, তখন গ্রামগঞ্জ, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সবাই উৎসাহ দিচ্ছে। সরকারও উৎসাহ দিচ্ছে।

একাত্তরে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দরিদ্ররা খুবই নাজুক ও কঠিন জীবনযাপন করত। আজকে যে হত দরিদ্র, সে কিন্তু অন্তত দু’বেলা খেতে পারে। দরিদ্র মানুষরা তিনবেলা খেতে পারছে। দেশ স্বাধীনের পর সে অবস্থা ছিল না। তার ওপর বন্যা, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক তোলপাড়। সে কারণে সত্তর ও আশির দশকে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, খুব করুণ অবস্থার মধ্যে ছিল তারা। তখন তারা চুলা জ্বালানোর মতো অবস্থায় ছিল না। এখন সে অবস্থা নেই। তখন নারীদের আয় করার সুযোগ প্রায় ছিল না। এখন আয় করার সুযোগ বেড়েছে। এখন নারীরা অনেক জায়গায় কাজ করতে পারছে, যা আগে সম্ভব ছিল না। আরও অনেক বৈষম্য এখন কমেছে। নারীদের জন্য শহর ও গ্রামে কাজের দ্বার খুলেছে। কিন্তু সে সুযোগ পুরুষের তুলনায় অনেক কম। মজুরিও পুরুষের চেয়ে কম। এত কিছুর পরও বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নারী-পুরুষের বৈষম্য হ্রাসে ভালো ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের জিডিপি, জিএনপি বেড়েছে, এটাও ইতিবাচক। গ্রামীণ নারীরা ভালো শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। আধুনিক কলাকৌশল ও তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে গ্রামের মহিলারা ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি, আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস, পশুপালনসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে।

বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি শিক্ষাক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। প্রাথমিকের ক্ষেত্রে ভর্তির হার এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি । বাংলাদেশ সরকার উচ্চশিক্ষার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৭-২০৩১ অবলম্বন করেছে। ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষায় (টারশিয়ারি) নারীদের ভর্তির হার ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০২২সালের হিসেব অনুযায়ি উচ্চশিক্ষার (ডিগ্রি/মাস্টার্স/পোস্ট গ্র্যাজুয়েট/অন্যান্য) ক্ষেত্রে ছাত্রীদের ভাগ ৪৫ দশমিক শূন্য ৩শতাংশ। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষা খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। প্রাথমিকে ছাত্রীসংখ্যা ১০৪-এর বিপরীতে ছাত্রসংখ্যা ১০০। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের অনুপাত সরকারি ক্ষেত্রে ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ৬৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। এসবই বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নে নারী শিক্ষার প্রসার বড়ো ভূমিকা রেখেছে।

নারীরা আজকে অনেক এগিয়েছে। নারীরা প্লেন চালাচ্ছে, পুলিশ হচ্ছে, ব্যাংকার হচ্ছে, অফিস-আদালতে বিভিন্ন জায়গায় কর্মমুখী হচ্ছে। আমাদের প্রাপ্তি হয়েছে অনেক। আর এর পেছনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে । অনেক নারী বিভিন্ন জায়গায় খুব সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে, কিন্তু এটি গোটা নারী জাতির কৃতিত্ব নয়। পৃথিবীর উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছে । নারীকে নানা বাধার মধ্যে কাজ করতে হয়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরুষরা দুটো কাজ করেছে; এক দেশ রক্ষার সংগ্রাম, আরেকটা জীবন রক্ষার সংগ্রাম। আর নারীরা দেশ রক্ষার সংগ্রাম এবং জীবন রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে রক্ষার সংগ্রামও করেছে। নারীর সংগ্রামটা এক কদম বেশি। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নারী সংরক্ষিত আসন বাড়ানো আর উপজেলা পরিষদে নারী ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করেছেন। ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদে নারীরা প্রথম সদস্য পদে নির্বাচনের সুযোগ পায় । সে সময় তাদের পরিষদের কক্ষেও বসার জায়গাও ছিলো না। বর্তমান সময়ে নারীরা এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে স্মার্টভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব জায়গায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কাজ করছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীকে কাজ করতে হবে। এ তিনটি সমানভাবে না এগোলে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব না। আগে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করার, তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য কোনো জায়গা ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদ হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নের প্রাথমিক প্ল্যাটফর্ম। সেখানে নারীর অংশগ্রহণের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশীদারি বাড়াতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সচিবালয় পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ আগের থেকে অনেক বেড়েছে।

দক্ষিণ অঞ্চলের অধিকাংশ নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নারী যতদিন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন না, ততদিন নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা কৃষিখাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন কুটিরশিল্পের জন্য এনজিও এবং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কাজ করে। তাদের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় অনেক প্রতিভা আছে, সেগুলো বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এ সমাজ তথা রাষ্ট্রকেই । গত দশকেও আমাদের দেশের নারীরা সকাল থেকে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বাইরের কোনো স্বপ্ন দেখতে পারত না। তাদের মাথার মধ্যে একটাই দুঃস্বপ্ন থাকত, কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হবে। এসব নারীরা ভাগ্যের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প সুদে কৃষি ও কুটিরশিল্প ঋণ নিয়ে এখন নিজেরাই উদ্যোগতা । এভাবে তারা ঋণ শোধ করে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে তারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখছে। আমরা যদি আসলেই বাংলাদেশের উন্নতি চাই, বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চাই তাহলে সামনে এগোতে হবে।

বাংলাদেশ অন্য দেশের চেয়ে ভালো না মন্দ, তা আমাদের দেখার দরকার নেই। আমরা দেখতে চাই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে আদর্শ হিসেবে। আর এ জন্যই নারীর অগ্রগতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে বড়ো যে বিষয়টি দরকার, তা হলো মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নারী কাজের সুযোগ পাচ্ছে, বাইরের জগতের সঙ্গে মিশছে । একদিকে নারীদের অবাধ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে চাকরির জন্য, শিক্ষার জন্য। অন্যদিকে নারীরা যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখছে সমাজ। পরিবারে পুরুষ আয় করছে, নারীও আয় করছে । নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীরা কাজ করছে। তারা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছে।এখন আর নারীরা শুধু সেলাই প্রশিক্ষণই নেয় না, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ক্যাটারিং, মোবাইল সার্ভিসিংসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সব প্রশিক্ষণ নিচ্ছে । একটা সময় ছিলো মেয়েশিশু জন্মের পর পরিবারের সদস্যরা যতটা খুশি হতো, ছেলেশিশু সন্তান জন্ম নিলে তার চেয়ে বেশি খুশি হতো । সব জায়গায় না হলেও অনেক পরিবার এসব চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এসবই ইতিবাচক নারীর অগ্রগতির জন্য।নারীকে রাজপথে আসতে হলে মেঠোপথ ধরে আসতে হবে। মেঠোপথ বা তৃণমূলে নারীর উন্নয়নে কাজ করতে হবে। তাঁদের মধ্যে সচেতনতা আর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চিন্তার জায়গাটা বদলাতে হবে। প্রতিটি মানুষকে নারীবান্ধব নয়, মূলত মানববান্ধব হতে হবে। সব মানুষকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। এটি শুধু নারী-পুরুষের শ্রদ্ধা না। শ্রেণিগত, জাতিগত, ধর্মগত শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। বিভাজন সৃষ্টি করলেই শ্রদ্ধার জায়গা কমে যাবে এবং নারীর অগ্রগতি বাধাগস্ত হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায় রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ ২০৪১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে বাংলাদেশে উত্তরণ ঘটবে। বিনির্মাণ হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। বাস্তবায়িত হবে ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০।

পিআইডি ফিচার

সর্বাধিক পঠিত