বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল

আর ও খবর

পরিবেশবান্ধব ব্যবসায় বাংলাদেশের তরুণদের ভবিষ্যৎ

গত কয়েক দশক ধরে পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে বিশ্ববাসীর সচেতনতা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের সর্বত্র তরুণদের মধ্যে সবুজ উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য তরুণ। ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ১৬ লাখ। অন্যদিকে, বাংলাদেশ নানান পরিবেশ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই পরিবেশবান্ধব নীতি নিয়ে ব্যবসায় এগিয়ে আসার এখন সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আমাদের তরুণরা যদি নিজেদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নকে টেকসই ধারণার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে পারে, তবে তারা দেশে একটি শক্তিশালী সবুজ অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলা অনেক সহজ হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনসহ বায়ু দূষণ, নদী দূষণ, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বাধার সৃষ্টি করছে। এগুলো জনস্বাস্থ্য এবং প্রাকৃতিক পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের বায়ুর মান সন্তোষজনক নয়। শীতকালে বায়ুর মানের আরও অবনতি হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ ২১ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে। এগুলোর ৬০ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয় না। এই অপ্রক্রিয়াজাত বর্জ্য নদীনালায় জমা হয়, কৃষিজমি দূষিত করে এবং শহরের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এই পরিস্থিতিতে পরিবেশবান্ধব পণ্য ও সেবা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। সবুজ উদ্যোগ শুধু পরিবেশগত সমস্যা সমাধান করছে না, বরং বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান এক ধরনের ভোক্তা শ্রেণি তৈরি করছে যারা পরিবেশ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। এটি বৈশ্বিক প্রবণতা। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বিশ্বব্যাপী ৬৬ শতাংশ ভোক্তা পরিবেশবান্ধব ব্র্যান্ডের পণ্যের জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতেও আগ্রহী। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে শহুরে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই প্রবণতা বাড়ছে। এই জনগোষ্ঠী পরিবেশবান্ধব ব্যবসার জন্য আদর্শ বাজার হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। প্লাস্টিকের বিকল্প নিয়ে কাজ করলে তরুণরা এই পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারবেন। তারা কম্পোস্টেবল (পচনশীল) ব্যাগ, সুপারির পাতা দিয়ে তৈরি প্লেট, কিংবা বাঁশের তৈরি টুথব্রাশ উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারেন। এই ধরনের আরও নিত্য নতুন পণ্য নিয়ে তরুণরা এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইকোভেশন এই ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ কম্পোস্টেবল পণ্য সরবরাহ করে ও প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরতা কমাতে কাজ করছে। সরকার সুপারশপ ও কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে এবং এগুলোর উৎপাদন, মজুত, পরিবহণ, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধের কার্যক্রম কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই উদ্যোগ পরিবেশবান্ধব উপাদান যেমন- কাপড়, পাট ও কাগজের ব্যাগের জন্য বড় বাজার সৃষ্টি করবে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক উৎপাদক হিসেবে বাংলাদেশ এখন টেকসই ফ্যাশনেও নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রথাগত টেক্সটাইল উৎপাদনে প্রচুর পানি ও বিদ্যুৎ দরকার। এই প্রক্রিয়া পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্তমানে দেশের ২২৯টি তৈরি পোশাক শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল থেকে লিড সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। লিড সার্টিফিকেট প্রাপ্ত শীর্ষ ১০০টি শিল্পের ৬১টি এখন বাংলাদেশে অবস্থিত।
এছাড়া, প্রাকৃতিক তন্তু পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে ও রপ্তানিতে প্রথম স্থানে অবস্থিত। পাটের বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক উদ্যোক্তা এখন পাট দিয়ে ব্লেজার, ল্যাপটপ ব্যাগ-সহ বিভিন্ন প্রকার জিনিসপত্র উৎপাদন করছে। ২০২০ সালে পাট শিল্প প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে। পাট শিল্পের আরও বেশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। পাট সহজে মাটিতে মিশে যায়। এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তরুণ উদ্যোক্তারা পাটের পাশাপাশি অন্যান্য টেকসই উপকরণ ব্যবহার করে বাংলাদেশকে টেকসই ফ্যাশনে নেতৃত্বকে আরও এগিয়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরেকটি একটি পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে প্রতিদিন ৬ হাজার টনের বেশি বর্জ্য তৈরি করে। এর মাত্র ১০ শতাংশ সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহৃত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকার ৮০ শতাংশ বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব। ঢাকার দুইটি সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনা সঠিক ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হলে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তরুণদের পরিবেশবান্ধব ব্যবসা পরিকল্পনা এই সমস্যা সমাধানে বেশ সহায়ক হতে পারে।
দেশের কিছু কিছু যুব সংগঠন প্লাস্টিকসহ অন্যান্য বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পণ্য তৈরি করছে। কাগজ, প্লাস্টিক, কাপড়, কাঁচ, বিভিন্ন ধরনের ধাতু সব কিছুই রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব। তাদের এই প্রচেষ্টা শহুরে এলাকায় বর্জ্য কমাতে সাহায্য করছে। তবে এই উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে, ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে ই-ওয়েস্টের পরিমাণও বাড়ছে। পুনর্ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। এসকল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন উদ্যোক্তা এগিয়ে এলে পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ভবিষ্যতের খাদ্য চাহিদা মেটাতে টেকসই সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি ও কৌশলের ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে তরুণ উদ্যোক্তারা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এজন্য এগিয়ে এসেছে। আরও নতুন উদ্যোক্তা প্রয়োজন টেকসই কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে। উদ্যোক্তাদের হাত ধরে কৃষকদের জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার মাটির ক্ষয় কমায় এবং ফসলের সহনশীলতা বাড়ায়। টেকসই চাষাবাদ তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সম্ভাবনাময় ব্যবসার ক্ষেত্র হতে পারে। এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা দেশের পরিবেশগত ক্ষতি কমাতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে পারেন।
বাংলাদেশ সরকার পরিবেশবান্ধব ব্যবসা সহায়তায় বেশ কিছু প্রণোদনা চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রকল্পে অর্থায়নে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করছে। ২০২৩ সালে ব্যাংক খাতে টেকসই অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ৮৭ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা মেয়াদি ঋণের ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসাবে দেশে টেকসই সবুজ প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। নতুন সবুজ উদ্যোক্তারা এই অর্থায়নের সুযোগ আরও কাজে লাগানো প্রয়োজন। এছাড়া, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) টেকসই জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
এছাড়া, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং বিশ্বব্যাংক পরিবেশ সচেতন উদ্যোগের জন্য তহবিল ও পরামর্শ সহায়তা প্রদান করছে। ইউএনডিপি’র ইয়ুথ কো-প্রোগ্রাম তরুণ উদ্যোক্তাদের পরিবেশগত এবং সামাজিক সমস্যার সমাধানে উৎসাহিত করে। এজন্য তরুণদের গ্র্যান্ট, নেটওয়ার্কিং, ও ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আছেন যারা প্রবল আগ্রহ নিয়ে সবুজ ব্যবসা শুরু করতে চান, কিন্তু অর্থ সংস্থানের অভাবে সেটি করতে পারছেন না। তাদের জন্য এধরণের আর্থিক সহযোগিতা ব্যবসায়িক উদ্যোগকে সফল করতে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। গ্লোবাল এন্টারপ্রেনিউরশিপ মনিটরের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুদ্র অর্থায়নের উৎসও তরুণ উদ্যোক্তাদের সীমিত পরিসরে ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করে। যেসব তরুণ সবুজ উদ্যোক্তা বড় পরিসরের অর্থায়নের সুযোগ পাচ্ছেন না, তারা গ্রামীণ ব্যাংকের মতো ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। অর্থায়নের সুযোগ ছাড়া পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ও পণ্য সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতার অভাব সবুজ উদ্যোগের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
সবুজ উদ্যোগের বিকাশে পরিবেশবান্ধব পণ্যের উপকারিতা সম্পর্কে গ্রাহকদের সচেতন তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উদ্যোক্তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের পণ্যের ইতিবাচক পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে গ্রাহকদের জানাতে পারেন। এতে তাদের পণ্যের একনিষ্ঠ গ্রাহকের সংখ্যা বাড়বে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী রয়েছেন। তাই সবুজ পণ্যের ব্যবসা সম্প্রসারণে সামাজিক মাধ্যম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট এনজিও, সরকারি সংস্থা ও পরিবেশ সংরক্ষণমূলক সংগঠনগুলোর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্যোক্তারা সবুজ ব্যবসার প্রসার বাড়াতে পারেন।
বাংলাদেশের টেকসই ভবিষ্যৎ গঠনে যুবশক্তি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। সঠিক সহায়তা পেলে তারা সফল উদ্যোক্তা হয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে একটি বড় অধ্যায় রচনা করতে সক্ষম হবেন। বিশ্বজুড়ে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসা খাত ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। সবুজ ব্যবসা বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন ধারণা করছে সবুজ ব্যবসা খাতে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় ২৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে। এশিয়া এই বাজারে একটি শক্তিশালী ভূমিকায় থাকবে। তাই, বাংলাদেশের আরও অধিক সংখ্যক তরুণ এই সম্ভাবনাময় খাতে প্রবেশ করলে পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখার পাশাপাশি একটি লাভজনক বাজারে নিজেদের অবস্থান করে নিতে পারবেন। মানুষ ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই এটি উপকারী। সবুজ উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা কঠিন হতে পারে। তবে উদ্দীপনা, উদ্ভাবন এবং ধৈর্যের সঙ্গে লেগে থাকলে বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তারা একসময় টেকসই ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠতে পারবেন।
#
লেখক: এ এইচ এম মাসুম বিল্লাহ,পরিচালক (মিডিয়া), জনকূটনীতি অনুবিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা
পিআইডি ফিচার

সর্বাধিক পঠিত

Social Media Auto Publish Powered By : XYZScripts.com