স্টাফ রিপোর্টার: আটমাস ধরে মজুরি পান না রাজশাহী রেশম কারখানার শ্রমিকেরা। ঈদের আগে মজুরির টাকা পাবেন কি না তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। এই রোজায় তাহলে সংসার চলছে কীভাবে, এমন প্রশ্ন করতেই প্রিন্টিং শাখার কর্মচারী জয়নাল আবেদীন লালন বললেন, ‘রোজার ইফতার-সেহরিতে কোনদিন শাক, কোনদিন আলুভর্তা, কোনদিন ডিমভাজি এই অবস্থা। ইফতারে হয়তো মুড়ি মাখিয়ে খেয়ে নিলাম বা হয়তো ভাত ছিল, ভাতই খেয়ে নিলাম।’
জয়নাল বলেন, ‘কোনদিন খাই, কোনদিন খেতে পারি না এই অবস্থায় সংসার চলছে। ধার-দেনা অনেক হয়ে গেছে। দোকানদারও আর বাকি দিতে চাচ্ছে না। আমাদের দৈনিক বেতন ৩০০ টাকা। এতে কি হয়? এক কেজি আটা এখন ৫৫-৬০ টাকা। এক কেজি চাল ৬০ টাকা, ৭০ টাকা। তাহলে কীভাবে আমাদের সংসার চলে? ঈদের আগে বেতন পাব বলেও তো মনে হচ্ছে না। ৩ রোজাতে টাকা দেওয়ার কথা ছিল, আজ ১৪ রোজা। আর কয়েকদিন বাদে ঈদ। বাচ্চা-কাচ্চার জামাকাপড় করব কি নিজের কিছু করব এ রকম কোন বুদ্ধি নাই।’
রাজশাহী মহানগরীর শিরোইল এলাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রায়াত্ব এই রেশম কারখানাটি ২০০২ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রাজশাহীর রেশমের ঐতিহ্য ফেরাতে এটি আবার চালু করা হয়েছে ২০১৮ সালে। তারপর পুরনো দক্ষ শ্রমিকদের অনেকেই কাজে ফিরেছেন। এখন কারখানার ৯টি লুমে কাপড় উৎপাদন চলছে। মাসে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার রেশম কাপড় উৎপাদন হচ্ছে। কারখানার কয়েকটি শাখায় এখন কাজ করছেন ৩৭ জন শ্রমিক। তারা ঠিকমতো মজুরি পাচ্ছেন না। তাই মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
কারখানার শ্রমিক মোসা. মুন্নির ২৫ বছরের ছেলে জিম দুইমাস আগে মারা গেছেন বিনাচিকিৎসায়। জন্ডিসে আক্রান্ত ছেলের চিকিৎসার জন্য কারখানায় পাওনা টাকার মধ্যে অন্তত দুই হাজার চেয়েও পাননি মুন্নি। বৃহস্পতিবার সকালে মুন্নি বললেন, ‘আটমাস থেকে বেতন নাই ভাই। সংসার খুব কষ্ট করে চলে। আমার বাচ্চা মরে গেল, ওরা টাকা দিল না। এরা মায়া-দয়া কিছু বুঝে না। এখানকার মাথাও ভাল না। যে কারখানা চালায় সেও ভাল না। আমরা কী করে চলছি এই রোজা-রমজানের দিনে কারও কি কোন চিন্তা আছে? ওরা তো বেতন পাচ্ছে, ওদের তো চিন্তা নাই। চিন্তা তো আমাদের। আজ দিব, কাল দিব, পোরশু দিব, দেয় না।’
ছেলের কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুন্নি। চোখের পানি মুছতে মুছতে মুন্নি বলতে থাকলেন, ‘আমার যে ছেলে মরে গেল, আমার পাওনা টাকা চাইতে গেলাম তা-ও দিল না। বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলে মারা গেল। এই দুঃখ কোথায় থুবো? এরা কোন চিন্তা-ভাবনায় করে না।’
প্রিন্টিং শাখার শ্রমিক পারুল বেগম বললেন, ‘আটটা মাস চলছে, একটা টাকা পাইনি আমরা। বেতনের কথা বলতে গেলে চলে যেতে বলে। আমাদের দিন চলছে খুব কষ্টের ওপরে। কোনদিন খাই, কোনদিন খাই না। যেদিন জুটাতে পারছি সেদিন খাচ্ছি, তা পারলে খাচ্ছি না। ছোট বাচ্চাদের যেমন ঘোরায়, সে রকম আমাদের দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে।’
এই কারখানার শ্রমিকদের কিছু দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। আর যারা লুম মেশিনে কাপড় বোনান, তারা প্রতি গজের জন্য পান ৫০ টাকা। তারা মাসে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকার কাজ করতে পারেন। উৎপাদিত কাপড় কারখানার প্রধান ফটকের পাশে শো-রুম থেকে বিক্রি করে টাকা জমা করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কিন্তু শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছেন না।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শ্রমিক শামসুল আলম বললেন, ‘কাপড় বুনে আমরা মাসে সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা তুলতে পারি। এই বেতনও এতদিন বন্ধ। খুবই কষ্টকর অবস্থা আমাদের। বাড়ির জিনিসপত্রও বিক্রি করতে হয়েছে। এখন মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। সামনে ঈদ, ঈদ তো আমাদের হবে না। কঠিন অবস্থা। আন্দোলন করলাম। তা-ও লাভ হলো না।’
বন্ধ হওয়ার আগে এই কারখানায় ৩১ বছর কাজ করেছেন আশরাফ আলী। নতুন করে চালুর পর আবার কাজ করছেন তিনি। আশরাফ বলেন, ‘কারখানা চালাবে এ রকম কোন পরিকল্পনা নাই। ঈদের মার্কেট ধরতে হবে সে চিন্তাও নাই। সামনে ঈদ, কী অবস্থা আমাদের? কর্মকর্তারা পোলাও-বিরিয়ানি খাবে, ওরাই খাক। ঈদের আগেও আমাদের বেতন দেয়নি। আটটা মাস চিন্তা করেন, আমরা বেতনই বা পাই ক’টাকা? আটটা মাস চলছে কিভাবে?’
সানোয়ার হোসেন আগে এখানে কাজ করেছেন ২৫ বছর। কারখানা চালুর পর ২০১৮ সালে আবার এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বেতন পাব কি পাব না তার কোন নিশ্চয়তা নাই। ঈদের আগে বেতন পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি। যদি হয় জুন-জুলাইয়ের পর, নতুন বাজেট পাস হলে। তার আগে কোন নিশ্চয়তা নাই। এখানকার এমপি ফজলে হোসেন বাদশাও কিছু করছেন না। বলছেন, দেন-দরবার করছি, কোন রেজাল্ট নাই। আসছেন, ঘুরছেন-ফিরছেন চলে যাচ্ছেন। দেশ-বিদেশ সফরে যাচ্ছেন। এই করে বেড়াচ্ছেন। আমাদেরকে তো মানুষই মনে করেন না। নয়ছয় দিয়ে বোঝাচ্ছেন আমাদেরকে।’
সানোয়ার জানান, ‘ঈদ নিয়ে রেশম কারখানায় বাড়তি কাপড় উৎপাদনেরও কোন পরিকল্পনা নেই কর্তৃপক্ষের। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে মানুষের একটা পরিকল্পনা থাকে। এখানে কিচ্ছু নাই। আমি নিজে বলেছি যে স্যার ঈদের মার্কেটটা ধরেন। ধরল না। এখন বন্ধ করে দিলেই বাঁচে।’
আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক এবং রেশম কারখানার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক কাজী মাসুদ রেজা বলেন, বাংলাদেশে শুধুমাত্র এখানেই খাঁটি রেশম কাপড় উৎপাদন হয়। তাই এর চাহিদা অনেক বেশি। এবার ঈদের আগেও অন্য বছরের তুলনায় বেশি কাপড় বিক্রি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভালভাবেই কারখানা সচল রাখার পরিকল্পনা আছে।
শ্রমিকদের মজুরি না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারখানা চালু করা হয়েছে ১৭-১৮ বছর পরে বন্ধ থাকার পরে। কিন্তু সরকারিভাবে কীভাবে চালানো হবে, সে রকম কোন সিস্টেমে আনা হয়নি। ভবিষ্যতে কোনো পরিকল্পনায় এনে ভাল করে চালানো হবে। আমাদের বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের মহাপরিচালক বলেছেন যেহেতু ঈদ আসন্ন, অন্তত তিনমাসের বেতনের যেন ব্যবস্থা করা হয়। আমরা ঈদের আগে এ টাকাটা দেওয়ার আশা করছি।’