মঙ্গলবার, মে ১৪, ২০২৪

নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল

আর ও খবর

কন্যা শিশুর অধিকার

গাজী শরীফা ইয়াছমিন : আরিফ ও নিশি’র পাঁচদিনের মেয়ে অহনা। অহনাকে দেখতে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড়। নিশিকে এক আত্মীয় ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, “মেয়ে হওয়ার জন্য বাড়ির লোক সবাই খুশি? কথা শোনায় নাই?” নিশি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে প্রশ্ন করার অর্থ। দৃঢ়ভাবে জানায় অহনাকে নিয়ে সবাই খুব খুশি।

আসলে শিশুতো শিশুই। ভেদাভেদ করে মানুষ। প্রায় পরিবারে মেয়ে শিশুর প্রতি অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়। অনেক শিক্ষিত মানুষ বলে থাকে যে ছেলে বা মেয়ে সন্তানের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু তারা আদতে ছেলে সন্তানই চেয়ে থাকেন। বংশরক্ষা কিংবা বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনা করার মতো খোঁড়া যুক্তি দিয়ে। এমনকি মেয়ে সন্তান হওয়ার জন্য পুরুষ দায়ী, এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি মাঝে মাঝে শিক্ষিত সমাজ মানতে নারাজ। তাই এই আধুনিক সমাজেও কোনো অন্যায় না করেও অনেক নারীকে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ কন্যাশিশু। বাংলাদেশে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬০ মিলিয়ন। এই শিশুদের অর্ধেকই কন্যাশিশু। শিশুর অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশে শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম শিশু অধিকার আইন প্রণয়ন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই আইনকে যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে শিশু আইন-২০১১ রূপে প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি), ১৯৮৯-এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন, নীতিমালাসহ সবক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে শিশুকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

 

আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কন্যাশিশুদের যথাযথ শিক্ষা, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বর্তমান সরকার সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কন্যাশিশুদের যথাযথ শিক্ষা, অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কন্যাশিশুদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে, তারা যোগ্য ও দক্ষ নাগরিক হয়ে উঠবে। এই লক্ষ্যে কন্যাশিশুদের কল্যাণে অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন, উপবৃত্তি প্রবর্তন, বিনামূল্যে বই বিতরণ, নারী শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সরকার জাতীয় শিশুনীতি-২০১১ ও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন (দমন) আইন-২০০০ এ নতুন ধারা সংযোজন এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। বর্তমান সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশুর উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এই শিশুদের মধ্যে অন্তত ১৫ শতাংশ কন্যাশিশু। বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের শিক্ষার অধিকার, খাদ্য ও পুষ্টির সুরক্ষা, আইনি সহায়তা, ন্যায় বিচারের অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা, বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধের লক্ষ্যে প্রতিবছর ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়। গতবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল- ‘সময়ের অঙ্গীকার, কন্যাশিশুর অধিকার’। করোনাকালে কন্যাশিশুর ওপর বঞ্চনা বেড়ে যাওয়ায় দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহে ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়।

২০১৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ নিরোধের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০৩০) নিয়েছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো, সার্বিক বাল্যবিবাহের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা। শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম চাবিকাঠি। শিক্ষা কন্যাশিশুর উন্নয়ন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং শিশু মৃত্যুর হার কমানোর প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং প্ল্যান বাংলাদেশের এক যৌথ জরিপ মতে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করা ২৬ শতাংশ নারীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। নিরক্ষর নারীদের বেলায় এই সংখ্যা ৮৬ শতাংশ। বর্তমান সরকার ছাত্রী ও নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্য নারীবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এর ফলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে ছাত্রী অনুপ্রবেশ এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।

জাতিসংঘের শিশু-বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানীয় দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশে ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়। ১৮ বছর বয়সের মধ্যে ৫২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। গত দুই দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক মেয়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণসহ নারী ও কন্যাশিশু উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে বাংলাদেশ। তথ্যানুযায়ী, করোনা বাস্তবতায় সারাবিশ্বের ৬৫০ মিলিয়ন বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া নারীর সঙ্গে নতুনভাবে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে পড়েছে আরও ১০ মিলিয়ন কন্যাশিশু। বাল্যবিবাহ নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানতম অন্তরায়। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কন্যাশিশুরা অনেক বেশি মাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে আছে। করোনা পূর্ববর্তী সময়েই বাংলাদেশের ৫২ শতাংশ মেয়ে শিশুই ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বাল্যবিবাহের শিকার হতো। করোনাকালে সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়া হয়। মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও তথ্য-উপাত্ত বলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীই আর ফিরে আসেনি। যারা ফিরে আসেনি, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এছাড়াও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশুধর্ষণ ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৭৪ জন কন্যাশিশু। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা যায়, ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় ৫৩ শতাংশই এ দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন এবং এই নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কন্যাশিশু। অর্থাৎ ভার্চুয়াল দুনিয়াতেও নিরাপদে নেই কন্যাশিশু।

সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে কন্যাশিশুদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সরকার সমাজে বই সম্মুখ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৫-২০২৫ মেয়াদে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি করেছে। যা ইতোমধ্যে ২৪টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ।সরকারের ১২০টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে ১৯ টি কর্মসূচি সরাসরি শিশুদের জন্য। কন্যাশিশুরা প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে সরকার নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ করেছে কন্যাশিশুরা পুষ্টি বৈষম্যের স্বীকার।

যে কোনো কল্যাণমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য নারী-পুরুষের অবদান অনস্বীকার্য। পুরুষরাই পৃথিবীর সব সৃষ্টির সাথে জড়িত নয়, নারীদের সুযোগ দিলে তারাও সবকিছু জয় করতে পারে। সেজন্য সব শিশুদেরই সমানভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার ও সুযোগ দিতে হবে। আদিকাল থেকেই পরিবার ও সমাজে কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। সমাজের নানা অসঙ্গতি ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ আজীবন কাজ করে গেছেন। তাদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও কন্যাশিশুর সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে দায়িত্ব নেওয়া উচিত। কারণ কন্যাশিশুকে বাদ দিয়ে কখনো টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব না।

লেখক: তথ্য অফিসার, পিআইডি।

পিআইডি ফিচার

সর্বাধিক পঠিত