অনলাইন ডেস্ক: বিশ্বের যেকোনো সংকটময় মুহূর্তে অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় বিভ্রান্তিকর তথ্য বা গুজব। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও দেখা গেছে যার ব্যাপকতা। চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ করে ফিলিস্তিনবিরোধী গুজবে ছেয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যম, কিছু ক্ষেত্রে তা উঠে আসছে মূলধারার গণমাধ্যমেও। আর এসব গুজবের বেশিরভাগই ছড়াচ্ছে ভারত থেকে। কিন্তু এর কারণ কী?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনবিরোধী গুজব ছড়িয়ে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ইসলামোফোবিয়া। আর সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে এসব গুজব সহজেই ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, গুজব সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে এক্স (সাবেক টুইটার) থেকে।
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গেল ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনবিরোধী যেসব গুজব ছড়িয়েছে তার বেশিরভাগই ছড়ানো হয়েছে ভারতের ডানপন্থিদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে।
এর মধ্যে অনেক অ্যাকাউন্টের পাশে আবার ‘ব্লু টিক’ (ভেরিফায়েড) রয়েছে, যার ফলে সহজেই গুজব বিশ্বাস করে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমনকি হামাস যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে বলে সম্প্রতি একটি টুইট হাজার হাজার মানুষ শেয়ার করেছেন।
ইসলামোফোবিক ‘প্রভাবকের’ উত্থান
গুজব ছড়ানোর পেছনে সম্প্রতি ভারতীয় বেশ কিছু ভেরিফায়েড এক্স ব্যবহারকারীকে শনাক্ত করেছে ভারতের অন্যতম নামকরা ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘বুম’।
সংস্থাটির তথ্যমতে, প্রভাবশালী যারা নিয়মিতভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য শেয়ার করছেন, তাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনকে নেতিবাচকভাবে টার্গেট করছেন বা ইসরাইলকে সমর্থন করছেন।
এমনকি ফিলিস্তিনিদের তারা ‘নৃশংস’ হিসেবেও দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো এক ভিডিওর কথা উল্লেখ করেছে বুম। যেখানে একদল কিশোরীকে দেখিয়ে দাবি করা হয়, ‘ফিলিস্তিনি’ যোদ্ধারা ওই কিশোরীদের অপহরণ করে ‘যৌনদাসী’ বানিয়েছে। তবে, ভিডিওটি সম্ভবত জেরুজালেমে কোনো স্কুল ভ্রমণের। অস্পষ্ট বা তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের হলেও মনোযোগ দিয়ে ভিডিওটি দেখলে বোঝা যায়, ওই কিশোরীরা বেশ আনন্দের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে এবং তাদের ফোন ব্যবহার করছে।
তা সত্ত্বেও, ভিডিওটি হাজার হাজার বার রিটুইট হয়েছে এবং সেটি দেখেছেন অন্তত ৬০ লাখ মানুষ। ভিডিওটি শেয়ার করা অ্যাকাউন্টগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর বেশিরভাগই ভারতে অবস্থিত।
সম্প্রতি প্রচারিত আরেক ভিডিওতে মিথ্যাভাবে দাবি করা হয়েছে, এক ইহুদি শিশুকে অপহরণ করেছে হামাস। ভিডিওটি শুধুমাত্র একটি পোস্টেই ১০ লাখের বেশি ভিউ পেয়েছে।
বিভ্রান্তিকর ভিডিও সমন্বিত শীর্ষ ১০টি সর্বাধিক শেয়ার করা টুইটের মধ্যে ৭টি ছিল ভারতভিত্তিক প্রোফাইল কিংবা তাদের বায়োতে রয়েছে ভারতীয় পতাকার ছবি।
কেবল এই সাতটি টুইট থেকেই ৩০ লাখের বেশি ইমপ্রেশন বা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। যদিও, যে ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে তা সেপ্টেম্বর মাসের এবং অপহরণ কিংবা গাজার সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
ইসলামোফোবিয়া, ভারত এবং সোশ্যাল মিডিয়া
ভুয়া ভিডিওগুলো শেয়ার করা অনেক অ্যাকাউন্ট এক্সে মন্তব্য পোস্ট করার জন্য বেশ সময়ও ব্যয় করছে।
সম্প্রতি ‘মি. সিনহা_’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে হামাসের হাতে এক শিশুর শিরশ্ছেদ হওয়ার ভুয়া ভিডিও শেয়ার করা হয়। একই পোস্টে ‘ইসলামইজদ্যপ্রবলেম’ (#IslamIsTheProblem) হ্যাশট্যাগও ব্যবহার করা হয়েছে।
এর আগে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘যৌনদাসী’ হিসেবে কিশোরীদের অপহরণ করার অভিযোগে যে ভুয়া ভিডিও প্রচার করা হয়, সেখানে লেখা হয়েছিল- ‘একমাত্র পার্থক্য হলো, যখন মুসলিম মেয়েরা হিন্দু ধর্মে রূপান্তরিত হয় তখন তারা সুখে থাকে। কিন্তু হিন্দু মেয়েরা যখন ইসলাম গ্রহণ করে তখন শেষ পর্যন্ত তাদের জায়গা হয় স্যুটকেস বা ফ্রিজে।’
ফিলিস্তিনের প্রতি বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়েছে অন্য আরও অনেকের পোস্টে। অবসরপ্রাপ্ত এক ভারতীয় সেনার অ্যাকাউন্ট থেকে বলা হয়, ‘ইসরাইলকে অবশ্যই পৃথিবী থেকে ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’
আন্তর্জাতিক অনেক বিশ্লেষকের মতে, ‘এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে, ভারতের ইসলামোফোবিয়া সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উত্থানের পর এই সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।’
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ইসলামিক কাউন্সিল অব ভিক্টোরিয়ার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইসলামোফোবিক টুইটগুলোর বেশিরভাগই আসছে ভারত থেকে।
গেল ৭ অক্টোবর হামাসের অভিযানের পরপরই ইসরাইলের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেয় ভারত সরকার। আর এরপর ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা পতঙ্গের মতোই যেন ইসলামবিদ্বেষীদের আলোর দিকে টেনে এনেছে এবং সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো গুজব এর বড় সাক্ষী। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আইটি সেলের বিরুদ্ধেও ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
‘গুজবের রাজধানী’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজেপির আইটি সেলের শুধু ইসলামোফোবিয়া নয়, গুজব ছড়ানোর সমস্যাও রয়েছে। গাজার সংঘাত নিয়েও তারা এখন সরব।
ভারতীয় অলাভজনক ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট এএলটিনিউজ-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক প্রতীক সিনহা এক টুইট বার্তায় লিখেছেন,
ইসরাইলের সমর্থনে ভারত এখন নিজেদের মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। আশা করি বিশ্ব এখন বুঝতে পারবে যে, ভারতীয় ডানপন্থিরা কীভাবে ভারতকে বিশ্বের গুজবের রাজধানী করে তুলেছে।
যদিও ইলন মাস্ক এক্স অধিগ্রহণ করার পর এই প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা রোধ করার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা সম্ভাব্যভাবে একটি নজির স্থাপন করেছে, যা অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টদের প্রভাবিত করতে পারে। উল্লেখযোগ্যভাবে, মেটা এবং ইউটিউবের মতো কোম্পানিগুলো তাদের প্ল্যাটফর্মে ঘৃণামূলক বক্তব্য, বিভ্রান্তি বা গুজব এবং অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয়বস্তু কমানোর জন্য বিদ্যমান প্রতিশ্রুতিগুলো পুনরায় মূল্যায়ন করছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন, অনেক ক্ষেত্রে টেক-জায়ান্টদের উদাসীনতা এবং ভারত থেকে ইসলামোফোবিক ডানপন্থিদের ছড়ানো গুজব গাজা সংকটকে এক বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে; যার মূল টার্গেট মুসলমানরা।