Home রাজশাহী সাপ আতঙ্কে শ্রমিক সংকট

সাপ আতঙ্কে শ্রমিক সংকট

সাপ আতঙ্কে শ্রমিক সংকট

স্টাফ রিপোর্টার: বরেন্দ্র অঞ্চলে অগ্রহায়ণের গোড়াতেই শুরু হয় মাসব্যাপী আমন ধান কাটার উৎসব। এবারও সোনালি ধানে ভরে গেছে দিগন্তজোড়া মাঠ। কিন্তু প্রাণঘাতী রাসেল ভাইপার আতঙ্কে ধান কাটা পরিযায়ী শ্রমিকের দেখা মিলছে না রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর প্রায় ৯ হাজার ৩২০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলে।

কৃষকরা জানান, গত কয়েক বছর ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলের ধানখেতে রাসেল ভাইপার বা বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়েছে। এই সাপের কামড়ে গত কয়েক বছরে শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে মারা গেছে শতাধিক ধান কাটা শ্রমিক। সাপের ভয়ে বাইরের জেলা থেকে এবার ধান কাটা শ্রমিক আসছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা, নাচোল ও গোমস্তাপুর, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার, পোরশার লালমাটির জমিতে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। পাকা ধানের জমিতে ইঁদুর শিকার করতেই মূলত এই সময়ে রাসেল ভাইপার আইলের গোপন গর্ত থেকে বের হয়। আর শ্রমিকরা ধান কাটতে গিয়ে সাপের ছোবল খায়। বিষধর এই সাপের ছোবলে শ্রমিকরা কেউ কেউ ঘটনাস্থলেই মারা যায়। কেউবা চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন। কেউ চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে গেলেও বিষের প্রভাব থাকে অনেকদিন। অনেক শ্রমিক কয়েক বছর পরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না।

নাচোলের শ্রমিক রুহুল আমিন জানান, গত বছর জমিতে কীটনাশক ছিটানোর সময় রাসেল ভাইপার তাকে ছোবল মারে। দ্রুত তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার সপ্তাহের চিকিৎসায় রুহুল আমিন প্রাণে বেঁচে গেলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সময় লেগেছে এক বছর। রাসেল ভাইপার আতঙ্কে তিনি এবার ১২ বিঘা জমিতে আবাদই ছেড়ে দিয়েছেন।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, বরেন্দ্র অঞ্চলে রাসেল ভাইপারের আতঙ্কে শ্রমিকরা এখন হাঁটু পর্যন্ত গামবুট পায়ে দিয়ে ধান কাটতে জমিতে নামছেন। ধান কাটার মৌসুমে দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিক (অন্য অঞ্চল থেকে আগত শ্রমিক) আসতেন বরেন্দ্র এলাকায়। এবার সেখানে শ্রমিকদের দেখা মিলছে না। ফলে পাকা ধান মাঠেই ঝরে পড়ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের কেন্দুয়া গ্রামের কৃষক সনিরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছর ধান কাটার সময় ৬ জন শ্রমিক রাসেল ভাইপারের কামড়ে মারা গেছে। আহত হয়েছেন আরও ১৭ জন। কেন্দুয়াসহ আশপাশের মাঠগুলোতে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেড়েছে। ফলে ভয়ে এবার বাইরের কোনো শ্রমিক আসেননি। ধান কাটা নিয়ে গ্রামের কৃষকরা বিপদে আছেন।

গোদাগাড়ীর খিরিন্দা গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। ধান পেকে জমিতে পড়ে আছে কিন্তু কাটার শ্রমিক পাচ্ছেন না। গত সপ্তাহে ধান কাটার সময় কৃষক শরিফুলকে সাপে কামড়ায়। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও অসুস্থ অবস্থায় এখন সে বাড়িতে আছে। এই এলাকায় এক সপ্তাহে তিনটি রাসেল ভাইপার মারা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আড্ডা এলাকার বাসিন্দা ও ধান কাটা শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক বছর আমরা নেজামপুর গ্রামের আশপাশে ধান কেটেছি। কিন্তু ওই এলাকাতে সাপের উৎপাত বেশি। তাই এবার ওইদিকে যাইনি।
অন্যদিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রাসেল ভাইপারের কামড়ে গত বছর ২২ জন ধান কাটা শ্রমিক মারা গেছে।

এছাড়া একই সময়ে ৫৭০ জন সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এ বছরের ১১ মাসে রাসেল ভাইপারের কামড়ে আরও ১৬ জন মারা গেছেন। রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, সাপে কাটা রোগী মারা গেলে বা চিকিৎসা নিতে এলে তারা নাম ঠিকানা ও সংখ্যার হিসাব রাখেন। উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষেধক এন্টিভেনাম সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এদিকে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব ও প্রতিকার সম্পর্কে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুনজের আলম মানিক বলেন, মূলত ধান কাটা শ্রমিকরাই রাসেল ভাইপারের ছোবল খাচ্ছেন বেশি। কিন্তু মেশিন দিয়ে ধান কাটা হলে সাপের কামড় থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে প্রতিষেধক এন্টিভেনাম সরবরাহ বাড়াতে হবে।

রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে শ্রমিকদের মোটা জিন্সে প্যান্ট ও গামবুট পায়ে দিয়ে ধান কাটার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকার মসজিদ থেকে মাইকিং করে প্রতিনিয়ত ধান কাটা শ্রমিকদের সতর্ক ও সচেতন করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here