Home রাজশাহী রামেক হাসপাতালে ভর্তির অব্যবস্থাপনায় দুর্ভোগে রোগীরা

রামেক হাসপাতালে ভর্তির অব্যবস্থাপনায় দুর্ভোগে রোগীরা

রামেক হাসপাতালে ভর্তির অব্যবস্থাপনায় দুর্ভোগে রোগীরা

স্টাফ রিপোর্টার: পাঁচটি ইউনিটে মেডিসিন ওয়ার্ড ১১টি। কিন্তু সব ওয়ার্ডে প্রতিদিন রোগী ভর্তি করা হয় না। রোজ শুধু একটি ইউনিটের একটি পুরুষ ও একটি নারী ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি করা হয়। ফলে রোগী ভর্তির দিন এবং তার পরের দিন এই ওয়ার্ডগুলোর মেঝেতেও রোগীদের জায়গা করে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। দুই ওয়ার্ডে রোগীদের যখন এত চাপ, অন্য ওয়ার্ডগুলো প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে এই অব্যবস্থাপনার জন্য বছরের পর বছর রোগীরা কষ্ট পাচ্ছেন। গ্রীষ্ণকালে ওয়ার্ডের বাইরের বারান্দা কিংবা করিডরে তীব্র গরমের মধ্যে তাদের শুয়ে থাকতে হয়। আবার শীতকালে শুয়ে থাকেন ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে। হাসপাতালে এই পরিবেশ পেয়ে অনেকে চলে যান। ভর্তি হন বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, কর্তৃপক্ষ অনেকবারই সব ওয়ার্ডে সমন্বিতভাবে রোগী ভর্তির চেষ্টা করেছে। কিন্তু জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এখন যেদিন যে ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি করা হয় শুধু সেদিন এবং তার পরেরদিন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা ওয়ার্ডটিতে রাউন্ড দেন। পরের দুইদিন তারা ওই ওয়ার্ডে রাউন্ডে যান না। পুরোপুরি বিশ্রামে থাকেন। ওই দুইদিন শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাই চিকিৎসা দেন। এতে রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা থেকে বঞ্চিত হন। বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী বাড়াতে সরকারী হাসপাতালটিতে রোগীদের এই ভোগান্তি দেওয়া হয় বলে মনে করেন অনেক রোগী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮. ৪২ ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডগুলো মেডিসিন বিভাগের। পাঁচটি ইউনিটে এসব ওয়ার্ডে সেবা চলে। চারদিন পর পর একেকটি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি করা হয়। সকাল ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত একেক ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি চলে। রোগী ভর্তির সময় দুজন করে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও একজন মেডিকেল অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। আর রোগী ভর্তির দিন সকালে এবং তার পরেরদিন সকালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ওয়ার্ডগুলোতে রাউন্ড দেন। যে ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি করা হয় না সেই ওয়ার্ডের রোগীরা দুইদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পান না। শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসকেরাই থাকেন।
শনিবার হাসপাতালের মেডিসিনের পুরুষ রোগীদের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে আর নারীদের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। রোববার সকালে ওয়ার্ড দুটিতে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডের ভেতরের সব বেডে রোগী। ওয়ার্ডের মেঝে, বাইরের বারান্দা এমনকি তারও বাইরের লম্বা করিডরে মানুষের হাঁটা পথের দুইপাশেই রোগীরা শুয়ে আছেন। রোগীদের চাপে কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। এ দিন মেডিসিনের অন্য ওয়ার্ডগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেখানে রোগীদের চাপ অনেক কম। কোথাও কোথাও ওয়ার্ডের ভেতরের বেডও পড়ে আছে ফাঁকা।
হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের রোগী নগরীর বহরমপুর এলাকার বাসিন্দা আবদুল হামিদ। রোববার ভোররাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওয়ার্ডের ভেতরে কিংবআ বারান্দার কোথাও জায়গা না পেয়ে তিনি করিডরে একেবারে প্রিজনার সেলের পাশে এসে শুয়েছেন। কিন্তু এখানে রোদের কারণে স্বস্তি পাচ্ছেন না। ছেলে হাবিবুর রহমান দুই হাতে একটি চাদর ধরে রেখে বাবাকে রোদ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
হাবিবুর বলেন, ‘হাসপাতালে এসে দেখছি কোন বেড নাই, বারান্দাতেও থাকার জায়গা নাই। এইরকম অবস্থা দেখে সকালে দেখলাম অনেকে চলে গেল। একজন জানালো, তাদের রোগীকে ক্লিনিকে ভর্তি করানো হবে। এ রকম পরিবেশে তো রোগী সুস্থ হতে সময় লাগবে। কেউ কেউ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। সব ওয়ার্ডে সমানভাবে রোগী দিলে এ সমস্যা হতো না। এখন রোগী থাকছে না, ক্লিনিকে যাচ্ছে। এতে তো ডাক্তারদেরই লাভ।’
ভর্তির পর রোগী কোন ওয়ার্ডে যাবে তা হাসপাতালের জরুরি বিভাগেই লিখে দেওয়া হয়। এভাবে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে এসেছেন ডায়রিয়ার রোগী রাকিবুল ইসলাম। তার বাড়ি নগরীর টিকাপাড়া এলাকায়। রোববার তিনিও শুয়ে ছিলেন বাইরের করিডরে। রাকিবুল বলেন, ‘এখান থেকে ওয়ার্ডের বাথরুম অনেক দূর। ডায়রিয়ার কারণে বার বার বাথরুমে যেতে হচ্ছে এত দূর থেকে। মনে হচ্ছে রাস্তার মাঝেই কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার রোগীদের সুবিধার জন্য বেশি বেশি ওয়ার্ড করেছে। সব ওয়ার্ডে সমন্বিতভাবে রোগী দিলে ভাল হয়। কিন্তু ডাক্তাররা রোগীদের সুবিধা চিন্তা করছেন না। তারা চিন্তা করছেন নিজেদের কথা।’
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ মাসুমা আক্তার মুক্তা জানান, ওয়ার্ডে বেড রয়েছে ৪৪টি। শনিবার সকাল ৮টায় ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি শুরুর আগে রোগী ছিলেন ২৮ জন। রোববার সকাল ৮টায় এখানে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৯ জন। আবার চারদিন পর এ ওয়ার্ডে রোগী দেওয়া হবে। মাসুমা বলেন, ‘আমি হাসপাতালে সাত বছর আগে এসেছি। আসার পর থেকেই এ নিয়ম দেখছি।’
রোববার সকাল থেকে পুরুষদের ৪২ ও নারীদের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি নেওয়া হচ্ছিল। ৪২ থেকে ৪৯ পর্যন্ত ওয়ার্ডগুলো পাশাপাশি। দুই ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির কারণে সকালে সবগুলো ওয়ার্ডের সামনেই রোগীদের হুড়োহুড়ি দেখা গেল। মানুষের গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কোনমতে একজন রোগী পাঠিয়ে অন্য রোগীর সমস্যার কথা শুনছিলেন।
সব ওয়ার্ডে রোগী না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাসান তারিক বলেন, ‘প্রতিদিন সব ওয়ার্ডেই যদি রোগী ভর্তি করা হয় তাহলে পুরো মেডিসিন বিভাগকেই এলার্ট থাকতে হবে। তখন ম্যানেজ করা আরও কঠিন হবে। ডাক্তারদের ডিউটি করতে হবে বছরের ৩৬৫ দিনই। চিকিৎসকেরা একদিনও বিশ্রাম পাবেন না। সার্বিক বিবেচনায় সব ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি করা যায় না।’
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, ‘এখন প্রতিদিন মেডিসিনের একটি ইউনিটে রোগী ভর্তি নেওয়া হয়। আমরা চিন্তা করছি, অন্তত দুটি ইউনিটে যেন রোগী ভর্তি করা যায়। ব্যাপারটি নিয়ে মেডিসিন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি আন্তরিক। আশা করছি এটা হবে। তাহলে রোগীদের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here