শত চেষ্টায়ও কমানো যাচ্ছে না চিকিৎসায় বিদেশমুখিতা, প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে এ খাতে। এটি প্রতিরোধে দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি। এজন্য স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোকে ঠেলে সাজানো দরকার। আমাদের দেশে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ আছে তেমনি বিপুল মানবসম্পদও রয়েছে; কিন্তু সেই সব সম্পদকে আমরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছিনা। আমাদের দেশে রোগীর তথ্য সংরক্ষণে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ নাই। অথচ এটা খুবই প্রযোজন। কতো সংখ্যক রোগী প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছে তারও সঠিক কোনো হিসেব নেই।
আমাদের দেশের চিকিৎসা সিস্টেমের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। সে আস্থা কমার পেছনে অনেক কারণও রয়েছে। দেশে ডাক্তাররা রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে চান না। অথচ ভারত, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের হাসপাতালের চিকিৎসকরা বেশি পয়সা নিলেও রোগীকে বেশি সময় দিচ্ছেন। আমাদের ডায়াগনস্টিক সেবার মান নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। আমাদের দেশে সেবা পেতে গিয়ে পদে পদে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় । দেশে সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। আমাদের দেশে কোনো জায়গায় কোনো সেবাটা মানুষ পাবে, সে তথ্যটিও কোথাও ভালো করে নেই। অথচ বিদেশিরা বাংলাদেশের মানুষের সাইকোলজি স্টাডি করেছে। তারা জানে কী করলে বাংলাদেশিরা খুশি হন এবং তারা সেটাই করেন। ফলে রোগীরা বিদেশে যান।
দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মালিকদের অভিমত হলো প্রতিবছর লাখ লাখ রোগী বিদেশে চিকিৎসা নিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার উপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ছে। যেহেতু বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের একটা বড়ো অংশ পার্শবর্তী দেশ ভারতেই চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যায় এখাতে বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড়ো অংশ চলে যাচ্ছে ভারতে। এর মধ্যমে ভারতের দ্রুত-বর্ধনশীল স্বাস্থ্য খাতকে শক্তিশালী করছে । অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ট্যুরিজমের শিকারে পরিণত হয়েছে। মেডিক্যাল ট্যুরিজম বা চিকিৎসা পর্যটন বা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া একটি দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতা প্রকাশ করে। বর্তমানে চিকিৎসা পর্যটন হলো ১০০ বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক ব্যবসা । ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো পাওয়ার হাউস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে । পশ্চিমা উন্নত দেশের চিকিৎসা খরচের তুলনায় এসব দেশে চিকিৎসা খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫ লাখ ডলার খরচ হতে পারে এমন একটি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ভারতে মাত্র ৫০ হাজার ডলারে করা যায়। প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করা বিলিয়ন ডলারগুলো যদি দেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোতে পুনঃবিনিয়োগ করা যেতো, তবে আমাদের অর্থনীতিতে এর নানামুখী সুফল পাওয়া যেতো ।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক অভিজাত শ্রেণির লোক চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতো। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়া জোয়ারে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে কম-বেশি সাড়ে ৪ লাখ বাংলাদেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ বেশি। এটা নিছক পরিসংখ্যান নয় বরং দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি নাগরিকদের অসন্তোষ প্রকাশ করে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি সাধারণ মানুষের যে আশা তা পূরণ করতে পারছে না এখাতে নিযোজিতরা। স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোও মানসন্মত নয়। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি স্বাস্থ্যসেবা, যেখানে বিশ্বমানের হাসপাতালগুলো সারাদেশে বিস্তৃত থাকবে, যা শুধু দেশের নাগরিকদেরই নয়, বরং বাইরের রোগীদেরও আকৃষ্ট করবে। যেখানে রোগীরা সুলভ মূল্যে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা পাবে। এটি কোনো অবাস্তব স্বপ্ন নয়, বরং একটি বাস্তব সম্ভাবনা। এজন্য প্রযোজন সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
আমাদের দেশে মেডিকেল ট্যুরিজম গড়ে তোলার জন্য প্রথমে ইকো সিস্টেম গড়ে তোলা জরুরি। হাসপাতালে শুধু ডাক্তার ভালো হলে চলবে না, রোগ নির্ণয়ের ল্যাব ভালো থাকতে হবে। প্রশিক্ষিত নার্স তৈরি করা জরুরি। যেমন দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা এখন বিশ্বমানে। তবে ক্যান্সারের চিকিৎসায় আমরা পিছিয়ে। কিছু কিছু জায়গাতে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে। আবার কিছু কিছু জায়গাতে দুর্বলতা রয়েছে। এগুলো দূর করতে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোতে পুনঃবিনিয়োগ জরুরি। আমাদের রোগীরা শিক্ষিত নয়। অসুস্থ হলে কোথায় যাবে তার সঠিক তথ্য কারও কাছে থাকে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নির্বাচনে জীবন শেষ হয়ে যায়। অনেকেই চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায়।
স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোখাতে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন যা হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা জায়ান্টদের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা নিশ্চিত করা দরকার । এর মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতির অগ্রগতিকে দ্রুততর করবে। এখাতে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, দক্ষতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি নিশ্চিত করা সম্ভব । দেশের চিকিৎসা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে হবে এবং মেধা ধরে রাখতে শক্তিশালী প্রণোদনা ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে হবে। যাতে মেধাবীরা দেশে ফিরে আসে অত্যাধুনিক সুবিধা এবং পেশাগত সন্তুষ্টি ও প্রতিযোগিতামূলক বেতনের আকর্ষণে বিদেশে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি ডাক্তাররা দেশে ফিরে এসে কাজ করেন। দুর্নীতি ও অদক্ষতাকে মোকাবিলা করার জন্য স্বচ্ছতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের স্বাস্থ্যখাতে মেডিকেল ট্যুরিজম গড়তে হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগের পাশপাশি দক্ষ জনবল তৈরি। শুধু চিকিৎসক নয় যে যে জায়গাতে রোগীরা সেবা নিতে যাবে সব জায়গায় দক্ষ জনবল প্রয়োজন হবে। রোগীর চাহিদা অনুযায়ী সর্বত্তোম সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বিলাসিতার কারণেও কিছু রোগী বিদেশ যায়, এগুলো বন্ধ করতে হবে। বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীরা যে বিষয়গুলো বেশি প্রাধ্যান্ন দেয় সেগুলো হলো; বিশ্বমানের চিকিৎসা সুবিধা; সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা; বিশেষ দক্ষতা; ভ্রমণের সহজতা; ভাষাগত সহায়তা । বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীরা প্রথমেই বিবেচনা করে বিশ্বমানের চিকিৎসা সুবিধা।তারপর দেখে এ সুবিধা কম টাকায় কোনো দেশে পাওয়া যাবে। সে সব দেশের বিশ্বমানের হাসপাতাল, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, অভিজ্ঞ পেশাদার চিকিৎসকসহ রোগ নিরাময়ে সফলতার হার বিবেচনা করা হয় । বিশেষ রোগের জন্য যেমন হৃদরোগ, কিডনী রোগ, লিভার সিরোসিস, নিউরো সমস্যা এবং ক্যানাসারের মতো অসুখের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত সেবা আছে কি না তা নিশ্চিত হতে চান রোগীরা। ভিসা প্রক্রিয়ার সহজ লভ্যতা অর্থাৎ দ্রুত ভিসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এরপর বিবেচনা করা হয় কানেক্টিটিভিটি ও ভাষা। রোগীরা যে দেশে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য যাবে, সে দেশে যাওয়ার জন্য দ্রুত এবং সাচ্ছন্দপূর্ণ ও খরচের বিষয়টি বিবেচনা করে থাকে। এরপর বিবেচনা করা হয় ভাষার বিষয় । আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গে বেশি মানুষ চিকিৎসার জন্য যায় তার কারণ হলো সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা,ভাষা একই এবং খরচও কম।
চিকিৎসা পর্যটনের জন্য শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড অন্যতম। থাইল্যান্ড চিকিৎসা ক্ষেত্রে একদিকে যেমন তাদের অবকাঠামো বিশ্বমানের করেছে, তেমনি পর্যটন স্থানগুলোকেও দৃষ্টিনন্দন করে সাজিয়েছে। উচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। ২০২৩ সালে, থাইল্যান্ড একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা ভিসা চালু করে, সহজ ভিসা প্রসেসের মাধ্যমে চিকিৎসা পর্যটকরা সর্বোচ্চ ৯০ দিন পর্যন্ত ভিসা পেয়ে থাকে। হাসপাতালগুলো বিশ্বমানের , বিদেশি রোগীদের জন্য আছে বিশেষ হেল্প ডেক্স এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী রোগীদের নিজ ভাষায় দক্ষ কর্মীর বিনা পারিশ্রমিকে সাহায্য নেওয়ার সুযোগ। বার্ষিক ৩০ লক্ষেরও বেশি চিকিৎসা পর্যটক নিয়ে থাইল্যান্ডের চিকিৎসা পর্যটন শিল্প মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপসহ বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। থাইল্যান্ডের চিকিৎসা পরিষেবা পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় ৫০-৭০ শতাংশ কম। তবে মানের সাথে আপস না করেই তারা রোগীদের এ চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে।
মেডিকেল ও ট্যুরিজমকে সমন্বিতভাবে উন্নত করতে হলে বাংলাদেশে আধুনিক চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি পর্যটন অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। বিশ্বমানের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত মেডিকেল সেন্টারগুলো যদি কক্সবাজার, সিলেট, রাঙামাটি বা সুন্দরবনের নিকটবর্তী স্থানে স্থাপন করা হয়, তাহলে দেশি-বিদেশি রোগীরা চিকিৎসার পাশাপাশি পর্যটনের সুযোগও পাবেন। উদাহরণস্বরুপ, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো তাদের পর্যটন খাতের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবাকে যুক্ত করে বিশাল বৈদেশিক আয় করছে। বাংলাদেশেও মেডিকেল রিসোর্ট, ওয়েলনেস ক্লিনিক এবং আয়ুর্বেদিক সেন্টার গড়ে তুললে, চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা সুস্থতার পর পর্যটন উপভোগ করতে পারবেন, যা সার্বিক অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করবে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক রোগীদের আকৃষ্ট করতে স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যটন খাতের জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। মেডিকেল ভিসা সহজীকরণ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ের হাসপাতাল সার্টিফিকেশন, বিশেষায়িত চিকিৎসা প্যাকেজ ও অভিজ্ঞতা উন্নত করতে ট্রান্সপোর্ট, আবাসন ও ভাষাগত সহায়তার মতো পরিষেবাগুলোর মানোন্নয়ন করা দরকার। বিদেশি রোগীদের জন্য বিশেষায়িত মেডিকেল ট্যুর প্যাকেজ চালু করা গেলে তারা চিকিৎসার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করতে পারবেন। এতে শুধু স্বাস্থ্যসেবা খাতই নয়, পর্যটন শিল্পও ব্যাপকভাবে লাভবান হবে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড়ো ধরনের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মানুষের সেবা পাওয়ার অনিশ্চয়তা, চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের আন্তরিকতার অভাব, সময়স্বল্পতা ও রোগীবান্ধব পরিবেশের অনুপস্থিতিও প্রকট। দেশে চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত না হওয়ায় বাংলাদেশিরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। ভারতে না পেলে অন্য দেশে যাচ্ছেন তারা। আর এতে লাভবান হচ্ছে বিদেশি চিকিৎসাসেবা খাত। এ বিষয়টি গুরুত্বের সাতে বিবেচনা করে বাংলাদেশও থাইল্যান্ডের চিকিৎসা পরিষেবা মডেলটি অনুসরণ করে খুব সহজেই মেডিকেল ট্যুরিজম গড়ে তুলতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং দক্ষতার সাথে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
ইমদাদ ইসলাম
পিআইডি ফিচার