রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হবে

রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে হবে

ঢাকা মহানগরীর খ্যাতি সুদীর্ঘকালের। এই মহানগরী এখন মানুষের বসবাস করার অযোগ্য হতে চলেছে । অথচ একটা সময় এই নগরীর খ্যাতি ছিল অতীতের বহু প্রসিদ্ধ শিল্পপণ্য, ব্যবসাবাণিজ্য ও বিস্তৃত প্রাচুর্যের কারণে। মসজিদের শহর ঢাকা । এখানকার আদিবাসীদের প্রধান পেশা ছিল মসলিন বস্ত্র তৈরি। জনশ্রুতি আছে, ঢাকা শহরে ৫২টি বাজার ও ৫৩টি রাস্তা থাকার কারণে এ শহরটিকে ৫২ বাজার ৫৩ গলি নামে একসময় অভিহিত করা হতো। সেই সময় ঢাকা শহরে বসবাসরত জনসংখ্যা ছিল লক্ষাধিক।
সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় নাগরিকদের এই শহরে এসেই ভিড় করতে হচ্ছে। ইচ্ছা থাকলেও নিরাপদ জীবনের খোঁজে অন্যত্র যাওয়া সম্ভব হয় না। ঢাকা শহরের প্রধান সমস্য হচ্ছে অধিক জনসংখ্যা । মাত্র সাড়ে তিনশ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস । যদিও বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা কম-বেশি এক কোটি ছয় লাখ । ঢাকায় ৪৮ হাজার মানুষ এক বর্গ কিলোমিটারে বাস করে। এতে করে সবচেয়ে জনবহুল রাজধানীর খেতাব পেয়েছে ঢাকা । আদর্শগতভাবে একটি শহরে একর প্রতি মানুষ বাস করা উচিত দুইশর কম। সেই তুলনায় ঢাকা শহরের একর জনঘনত্ব অনেক বেশি, কোনো কোনো এলাকায় সেটি সাড়ে তিনশ পেরিয়ে গেছে। যেমন, লালবাগ এলাকায় এই সংখ্যাটি ছয়শর মতো। মানুষের ভারে নুয়ে পড়ছে অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরী। কর্মসংস্থান, ভাগ্যান্বেষণ, লেখাপড়া চিকিৎসা কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে দেনদরবার করার জন্য গ্রাম থেকে এই নগরীতে স্রোতের মতো মানুষ প্রতিদিন ছুটে আসছে। প্রশাসনিক সব কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় মানুষের ঢাকায় আসতেই হয়।
জায়গার ক্যারিং ক্যাপাসিটির চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ঢাকা শহরে বাস করে।ক্যারিং ক্যাপাসিটির বেশি পরিমাণ মানুষ যখন একটি জায়গায় বসবাস করেন, তখন সেখানে কয়েকটি নেগেটিভ এক্সটারনালিটিজ তৈরি হয়। এর মধ্যে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের দূষণ তৈরি হয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় মারাত্মক স্বাস্থ্য সংকট। এই সংকটের সবচেয়ে বড়ো শিকার নারী ও শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। এই মৃত্যুর বেশির ভাগ সংঘটিত হয় ঢাকায়। বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়শই এক নম্বরে উঠে আসে ঢাকা। উন্নয়ন যন্ত্রণা হিসেবে ক্রমেই দূষণের মাত্রা বাড়ছে। বন্ধ করা যাচ্ছে না বায়ু দূষণের উৎস। এতে মানুষের জীবনমান অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে । জনসংখ্যার বিপরীতে যে পরিমাণ নাগরিক সুবিধা থাকা উচিত, সেটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। মানুষের ভিড় আর অসহনীয় যানজটের কারণে জীবনের গতি যেন থেমে যাচ্ছে। সরকার যানজট কমানোর জন্য মেট্রোরেল, ফুটওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ যাতায়াতের সুবিধার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সুষ্ঠু এবং যথাযথ পরিকল্পনার অভাব ছাড়াও নগরবাসীর একটা বড়ো অংশের ট্র্যাফিক আইন না মানার কারণে যানজট না কমে উলটো আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ মহানগরী শুধু আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেই বিপর্যস্ত করছে না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও বাড়িয়ে দিয়েছে শ্রেণিবৈষম্য।
নগরীর গণপরিবহণগুলোতে বেশিরভাগ সময়ই যাত্রীদের দাঁড়ানোর মতো জায়গাও থাকে না। বাইরে বের হলে বাসের দরজায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের ঝুলে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ে। অফিস সময়ে বাসে জায়গা পাওয়া যায় না যে কারণে লোকজন ঠেলেঠুলে হলেও বাসে উঠে। অনেকসময় ভেতরে একদমই জায়গা থাকে না, সেক্ষেত্রে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়।কাজের ক্ষতি হয় সময়ও নষ্ট হয়। ঢাকার রাস্তায় যানজট, বাসে ভিড়, ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলাচল করা যায় না । চলাচলের সব বিকল্প বন্ধ। ফলে রাস্তায় বের হলেই দুর্ভোগ পোহাতে হবে এটা নিশ্চিত। ২০০৫ সালেও ঢাকা শহরে গাড়ির গতি ঘণ্টাপ্রতি ২৫ কিলোমিটার ছিল। এখন সেটা ঘণ্টায় কম-বেশি পাঁচ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এ শহরের ট্র্যাফিক ব্যবস্থাও কাজ করছে না। ২০২৩ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মৃত্যু হয়েছে তার ২৯ শতাংশ ঢাকা নগরীতে। যখন কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন তাৎক্ষণিকভাবে হইচই পড়ে যায়। গণমাধ্যমগুলো গরম গরম খবর সরবরাহ করে, তারপর এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। ঢাকা শহরের ভিআইপি সড়কগুলো ছাড়া এমন কোনো সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে সারা বছরই রাস্তা বন্ধ করে সড়কের বা সড়কের পাশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে রাস্তা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনার সময় ফায়ার সার্ভিস অ্যাম্বুলেন্সসহ উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরী ডুবে যায়। সুয়ারেজ লাইনগুলোতে উপচে পড়েছে ময়লা । দুর্গন্ধে আশেপাশের মানুষের জীবন বাঁচানোই দায়।
ঢাকায় মানসম্মত আবাসিক এলাকার ঘাটতি প্রকট। ঢাকা শহর নিজের আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে। বিশেষ করে পুরো ঢাকা এখন একটা মিশ্র ব্যবহারের এলাকা হয়ে গেছে। ঢাকার সর্বপ্রথম পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ছিল ওয়ারী। আর আধুনিককালে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি, বনানী ও গুলশান। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা করা হয় ১৯৬০ সালে। আশির দশকের শুরুর দিকে গড়ে উঠতে শুরু করে রাজধানীর উত্তরা। এগুলো আবাসিক হিসেবেই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। উত্তরার কোনো কোনো এলাকা, বিশেষ করে মূল রাস্তা থেকে দূরের এলাকাগুলো কিছুটা হলেও এখনো আবাসিক আছে। দিয়াবাড়িতে কিছু এলাকা আবাসিক হিসেবে গড়ে উঠছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কোনো কোনো এলাকা মিশ্র আবার কোনো কোনোটা আবাসিক। মোহাম্মদপুর এলাকা একসময় পুরোপুরি আবাসিক ছিল, সেটা এখন বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। আগে বাণিজ্যিক এলাকা বলতে মতিঝিল ও দিলকুশাকে বুঝাতো। এখন বিভিন্ন আবাসিক এলাকার কাছেও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে উঠছে। যেমন গুলশান, এখানে মূল সড়কের কাছাকাছি এলাকা বাণিজ্যিক। ফলে এটাকে পুরোপুরি আবাসিক এলাকা না বলে মিশ্র বলা যায়। আবার, বারিধারার ডিওএইচএস এখনও আবাসিক এলাকা আছে।
ঢাকায় অর্থ উপার্জনের সুযোগ সবচেয়ে বেশি থাকা সত্ত্বেও এ শহরের দরিদ্র লোকের মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কিন্তু শহরে ভিন্ন জেলা থেকে মানুষ স্রোতের মতো আসছেই। ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আয়বৈষম্য প্রকট হচ্ছে।এখনো তিনবেলা খেতে পায় না ঢাকার কম-বেশি সাড়ে তিন শতাংশ মানুষ। ঢাকায় বসবাসকারী কম-বেশি আশি শতাংশ মানুষের নিজস্ব কোনো বসবাসের জায়গা নেই,ভাড়া বাসায় থাকে। ঢাকার ১০ শতাংশ উচ্চবিত্তের আয় গোটা শহরের বাসিন্দাদের মোট আয়ের কম-বেশি ৪৪ শতাংশ। এছাড়া সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় শহরের মোট মানুষের আয়ের এক শতাংশেরও কম। সিটি করপোরেশন এ শহরের নাগরিকদের ন্যূনতম সেবা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না।
ঢাকার প্রধান সমস্যা হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ঢাকা শহরের চারদিকে গ্রাম দখল করে নতুন নতুন উঁচু ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিবছর ঢাকার আয়তন বাড়ছে ৩ শতাংশ হারে। বিশ্বের বড়ো শহরগুলোর মধ্যে এই বৃদ্ধি সর্বোচ্চ। গত দুই যুগে এখানকার জনসংখ্যা পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের ওপরে এখানে বসবাস করে। আবাসন কোম্পানি ও ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব নতুন জায়গায় নগরায়ণের কোনো আধুনিক নীতিই মানা হয় না। মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্ব, পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ বায়ুদূষণ,পলিথিন দূষণ,পানি ও কেমিক্যাল দূষণে বিপন্ন জলাশয়, খোলা জায়গায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নিকৃষ্ট সুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি যানজট এবং শব্দদূষণের মতো ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর সমস্যা থেকে ঢাকাকে বাঁচানোর উপায় আমাদের খুঁজতেই হবে। ঢাকার শহরের এই পরিস্থিতি রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। সেটি করতে গেলে কিছু কিছু কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে অনেক নগর শুধু পরিকল্পনাহীনতার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ঢাকার সবকিছু নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি।
আমরা সমস্ত কাজ ঢাকাকেন্দ্রিক করে ফেলেছি। কিছু কিছু কাজ সরিয়ে নিয়ে ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে ফেলা দরকার। বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে ঢাকার প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যাবে, আর দেশের চারদিকে মানুষ ছড়িয়ে পড়বে। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়। তাহলে লোকজন নিজের বাড়িতে কিংবা এলাকার কাছাকাছি বসবাস করা শুরু করবে। বিশ্বের চল্লিশটির মতো দেশ তাদের রাজধানী অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। কয়েকটি দেশ এ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। সর্বশেষ ইন্দোনেশিয়া তাদের রাজধানী পরিবর্তন করে নুসানতারায় নিয়ে গেছে। মিসরও চলে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাজধানী সরিয়ে নেওয়া খুবই খরচের বিষয়। রাজধানী না সরিয়ে পুত্রজায়ায় একটি প্রশাসনিক এলাকা গড়ে তুলেছে মালয়েশিয়া। জার্মানিও রাজধানী না সরিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টকে অর্থনৈতিক রাজধানী করেছে। বাংলাদেশেরও এ বিষয়গুলো ভেবে দেখার সময় এসেছে।
ঢাকা কেবল একটি শহর নয়, এটি একটি জীবনপ্রবাহ। এখানে প্রতিদিনের সংগ্রাম, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার সাথে লড়াই করে চলে লাখো মানুষ। এই শহরকে টিকিয়ে রাখতে হলে শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, দরকার সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিনির্ধারণ। নগর পরিকল্পনার সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ, এবং দায়িত্বশীল নাগরিক সমাজ গড়ে তোলাই হতে পারে টেকসই ঢাকার প্রথম ধাপ। পরিকল্পিত ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি নগর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার পূর্বশর্ত। এখনই সময় আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ঢাকার জন্য সম্মিলিতভাবে ভাবতে হবে। কেননা, একটি শহর ধ্বংস হয়ে গেলে শুধু ভবন নয়, ভেঙে পড়ে মানুষের আশা, গতি ও জীবনের মান। এই শহর আমাদের—এটাকে বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্বও আমাদেরই।

আরও পড়ুনঃ  গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা ও প্রত্যাশা

ইমদাদ ইসলাম
পিআইডি ফিচার

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *