স্বাগত ১৪৩২ : নতুন সূর্য, নতুন সম্ভাবনা

স্বাগত ১৪৩২ : নতুন সূর্য, নতুন সম্ভাবনা

অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের মাঝে পহেলা বৈশাখ আসছে এক নতুন মাত্রা নিয়ে। বাংলা ১৪৩১ সন ছিল আমাদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক পর্যায়ে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। যার ফলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটে এবং জাতির সামনে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ আসে। পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশের চিরন্তন উৎসব, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। পয়লা বৈশাখ আমাদের আপন শিকড়ের প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হওয়ার দিন, বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। বাঙালি আবহমান লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যে বর্ষবরণ উৎসবে মেতে ওঠে সারা দেশ। বাংলা নববর্ষ পালন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।

বাংলা নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, একসময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো। সৌর পঞ্জি অনুসারে বাংলা মাস পালিত হতো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই। তখনও আসাম, তামিলনাড়ু, ত্রিপুরা, বঙ্গ, পাঞ্জাব প্রভৃতি সংস্কৃতিতে বছরের প্রথম দিন উদ্‌যাপনের রীতি ছিল। বাংলা সনের প্রবর্তক নিয়ে সম্রাট আকবর বেশি আলোচিত হলেও, বাংলা পঞ্জির উদ্ভাবক ধরা হয় আসলে ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্ককে। পরবর্তীতে সম্রাট আকবর সেটিকে পরিবর্তিত করেন খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে। প্রথমে আকবরের পঞ্জিকার নাম ছিল ‘তারিখ-এ-এলাহী’। আর ঐ পঞ্জিকায় মাসগুলো আর্বাদিন, কার্দিন, বিসুয়া, তীর এমন নামে ছিল । তবে ঠিক কখন যে এই নাম পরিবর্তন হয়ে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ হলো তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। ধারণা করা হয় বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন – বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জ্যৈষ্ঠ, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ এমন করেই বাংলায় নক্ষত্রের নামে মাসের নামকরণ হয়েছে।
ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো, হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। আর হিজরি পঞ্জিকা চাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিল । যেহেতু কৃষকদের কৃষি কাজ চাঁদের হিসাবের সাথে মিলতো না, তাই তাদের অসময়ে খাজনা দেওয়ার অসুবিধা দূর করার জন্য সম্রাট আকবর বর্ষ পঞ্জিতে সংস্কার আনেন। তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সম্রাট আকবরের আদেশে সৌর সন ও হিজরি সন এর উপর ভিত্তি করে বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে প্রথম বাংলা সন গণনা করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবেই খাজনা আদায়ে এই গণনা কার্যকর শুরু হয়েছিলো ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। পূর্বে ফসল কাঁটা ও খাজনা আদায়ের জন্য ঐ বছরের নাম দেয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ আর বাংলা সন করা হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা, শুল্ক দিতে হতো কৃষকদের। তাই তখন থেকেই সম্রাট আকবর কৃষকদের জন্য মিষ্টি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। হালখাতার প্রচলনও সম্রাট আকবরের সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা শুরু করেছিলো।

আরও পড়ুনঃ  টেকসই উন্নয়নে নারী শিক্ষা

পহেলা বৈশাখ, বাংলা সনের প্রথম দিন। এ দিনটি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশবিদেশে বসবাসরত প্রত্যেকটি বাঙালি নববর্ষ হিসেবে পালন করে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন প্রাণের উৎসব। বর্তমানের বাংলা সন এসেছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশে এই গ্রেগরীয় বর্ষ পঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল শুভ নববর্ষ পালন করা হলেও পশ্চিম বঙ্গে তা ১৫ এপ্রিল পালন করা হয়। কারণ, ভারতে হিন্দু সম্প্রদায় তিথি পঞ্জিকা অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশে আধুনিক বাংলা বর্ষ পঞ্জিকায় গ্রেগরীয় পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা একাডেমি ১৪ এপ্রিলকে বাংলা বছরের প্রথম দিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সক্রিয় ক্রীড়াঙ্গন

বাঙালির নববর্ষ উদ্‌যাপনের অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিত এ শোভাযাত্রা বের করে। শুরুতে নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো, এটিকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বাংলাদেশের নবতর সর্বজনীন সাংস্কৃতিক এবং প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে বাঙালির জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই আয়োজনে দেশি বিদেশি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ গ্রহণ করে থাকে। এবছর থেকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ করা হয়েছে। এ বছর নববর্ষের শোভাযাত্রায় বাঙালি ছাড়াও ২৭ জাতিগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করবে। শোভাযাত্রায় কৃষক একটি বড় থিম হিসেবে থাকবে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে শান্তির বার্তাও থাকবে এবং ২ শত গিটারিস্ট নিয়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদে গান পরিবেশন করবে রকস্টার ব্যান্ড বামবা। ঐদিন বিকেলে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে কনসার্ট অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া চীনা দূতাবাসের অর্থায়নে বিকেলে ড্রোন শো হবে। যেখানে ২৪-এর জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আয়োজন থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কনসার্ট হবে চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যায়। প্রতিবারের মতো এবারও ছায়ানটের অনুষ্ঠান হবে। তবে স্থান বদলে সুরের ধারার অনুষ্ঠানটি এবার রবীন্দ্র সরোবরে হবে। সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সুরের ধারা এবার বাংলা গানের বাইরেও ভিন্ন আয়োজন রাখবে । সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আয়োজন করা হবে বৈশাখি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আসন্ন বাংলা নববর্ষ এবং পাহাড় ও সমতলের জাতিগোষ্ঠীদের বর্ষবরণ উৎসব উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সাজসাজ রব পড়েছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। নববর্ষ উপলক্ষ্যে সব মাদ্রাসায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনা উৎসবমুখর পরিবেশে ও সাড়ম্বরে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন করার কথা জানিয়ে নির্দেশনা জারি করেছে শিক্ষা অধিদপ্তর। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখি মেলা। তাই বৈশাখ মাসকে বলা হয় মেলার মাস। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে জেলায় জেলায় বৈশাখি মেলারেও আয়োজন করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা ও প্রত্যাশা

আগামী সোমবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হবে নতুন বর্ষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ। বিদায়ী ১৪৩১ এর সব ভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা, গ্লানি আর না পাওয়াকে ভুলে নতুন উদ্যমে ১৪৩২ কে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরো জাতি। এ উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। নতুন বছরে তারুণ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে গড়ে তুলতে হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশকে। তরুণরাই থাকবে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্বে । সেবা ও মানবিকতার বাণী পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বলেছেন,‘বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার বিশ্বকে বদলে দেওয়ার অভিনব সব ধারণা রয়েছে। এসব ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আর এর মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকেই বদলে দেওয়া সম্ভব’। আর এ বিশ্বাসকে ধারণ করে এগিয়ে নিতে হবে বাংলাদেশকে। নতুন বর্ষ আমাদের সকলের জীবনে মঙ্গল বয়ে আনুক এ প্রত্যাশা ।

ইমদাদ ইসলাম (পিআইডি ফিচার)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *