সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সক্রিয় ক্রীড়াঙ্গন

সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সক্রিয় ক্রীড়াঙ্গন

প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পাস পর্বতের পাদদেশে যে খেলাধুলা হতো পরবর্তীতে সেটি অলিম্পিক নামে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিতি পায়। অলিম্পিক মানেই ক্রীড়ার মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের অন্তর্ভুক্তি। এটি ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, পর্বতের পাদদেশ থেকেই সূচনা ঘটেছে আধুনিক সভ্যতার ঐতিহ্যে লালিত ক্রীড়াঙ্গন। অপরদিকে আমাদের এই গাঙ্গেয় উপত্যকা, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের উর্বর এই ব-দ্বীপ, যা আমাদের মাতৃভূমি – সুউচ্চ পর্বতমালা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত না হলেও হিমালয়ের নিবিড় ছোঁয়া থেকে খুব একটা দূরেও নয়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক এক ঐতিহ্যমণ্ডিত ভূমি যার ইতিহাস বেশ পুরাতন।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সামগ্রিক গুরুভার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপর ন্যস্ত আছে। উক্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দপ্তর হিসেবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সার্বিক উন্নয়ন ও সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। ক্রীড়ার মানোন্নয়নে গুরুত্ব প্রদানের অংশ হিসেবে সরকার এ প্রতিষ্ঠানকে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলেছে। পাশাপাশি ক্রীড়া অবকাঠামো নির্মাণ, মেরামত, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো বৃহত্তর দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানের উপর অর্পিত আছে। মূলত দেশের সামগ্রিক ক্রীড়া তৎপরতা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে থাকে।
এটি অনস্বীকার্য যে, সময়ের পরিক্রমায় দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। পাশাপাশি ক্রীড়া অবকাঠামোর বুনিয়াদ শক্ত হয়েছে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্রীড়ার ব্যাপ্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সকল উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ১২৫টি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। আরও ২০১টি উপজেলায় এরূপ মিনি স্টেডিয়ামের নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পাশাপাশি ০৪টি বিভাগীয় স্টেডিয়াম, ৬৪টি জেলায় ৬৮টি জেলা স্টেডিয়ামসহ দেশব্যাপী ১৮টি সুইমিংপুল, ১০টি ইনডোর স্টেডিয়াম, ০৭টি ক্রীড়া কমপ্লেক্স, ০৬টি অন্যান্য প্রকৃতির স্টেডিয়াম ইত্যাদি ক্রীড়া অবকাঠামোর উপর দেশের সামগ্রিক ক্রীড়াক্ষেত্র সক্রিয় পদচারণায় বিভোর রয়েছে। এ সকল কর্মকাণ্ডের প্রতিটিতে রয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বলিষ্ঠ ছোঁয়া।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় দেশের ক্রীড়াঙ্গণকে এগিয়ে নিতে তৃণমূল পর্যায়ে শিশু কিশোর ও তরুণদের ক্রীড়ায় উদ্বুদ্ধ করে ক্রীড়া সচেতনতা তৈরি এবং উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ খেলোয়াড় সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রীড়ার উৎকর্ষ সাধনে অত্যন্ত সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ দেশের ৫৫ টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধান এবং ক্রীড়ার মানোন্নয়নে কাজ করছে। ক্রীড়া পরিদপ্তর তৃণমূল পর্যায়ে দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করে ক্রীড়ার সার্বিক মানোন্নয়নে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাভারে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) দেশের ক্রীড়া শিক্ষা এবং খেলোয়াড় তৈরিতে অনন্য অবদান রেখে চলছে। বাংলাদেশ ক্রীড়াসেবী কল্যাণ ফাউন্ডেশন ক্রীড়া ভাতা, ক্রীড়া বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে অসচ্ছল ক্রীড়াবিদদের সহায়তা করে আসছে।
প্রশংসনীয় দিক এই যে, আমাদের ক্রীড়া তৎপরতা আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের মাটিতে আমাদের ক্রিকেট দল প্রথম বারের মতো টেস্ট সিরিজ জয় করেছে; পরপর দুইবার বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো গৌরব অর্জন করেছে যা দৃশ্যমান করে: “ Win is not a miracle”; বাংলাদেশ জাতীয় যুব হকি দল সম্প্রতি ওমানে অনুষ্ঠিত এশিয়া যুব হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ৫ম স্থান অর্জন করে আসন্ন বিশ্ব যুব হকিতে প্রথমবারের অংশগ্রহণ করার বিরল যোগ্যতা অর্জন করেছে; জাতীয় মহিলা কাবাডি দল ইরানে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ এশিয়া কাবাডি টুর্নামেন্টে কৃতিত্বের সাথে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করার গৌরব অর্জন করেছে – যা দেশের নারী কাবাডি দলের জন্য প্রথম পদক প্রাপ্তি। উল্লেখ্য, আর্চারি-তে আমাদের সাফল্য আজ বিশ্ব দরবারে বিশেষভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। দাবা, শ্যুটিং স্পোর্টস ইত্যাদিতেও আমরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। পাশাপাশি চলমান প্রেক্ষাপটে ক্রীড়াঙ্গনে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সকল বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার বিদ্যমান কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। নতুন কমিটি গঠনের কাজও এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে ২১টি ফেডারেশনের নতুন অ্যাডহক কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অধিকন্তু ক্রীড়াসংস্থার প্রাণ হিসেবে খ্যাত আদর্শ গঠনতন্ত্র প্রণয়নসহ ক্রীড়া উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব সক্রিয়ভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
গৌরবের সাথে উল্লেখ করার মতো কার্যক্রম এই যে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রণীত “এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই” শীর্ষক উদ্দীপক স্লোগানকে প্রতিপাদ্য করে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ হতে দেশব্যাপী উদ্‌যাপিত হয়েছে “তারুণ্যের উৎসব ২০২৫ যা এখনো চলমান রয়েছে। এই মহোৎসবের মূল লক্ষ্য একটিই তারুণ্য নির্ভর এই দেশটির, দুই তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা, যাদের বয়স ১৮-৩৫ (Demographic dividend) তাদেরকে জাতীয় সম্পদে রূপান্তরিত করা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল)-এর প্ল্যাটফর্মকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রাম থেকে শহর, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উন্নত নগর সকল স্তরের তরুণ-যুবসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্‌যাপিত হয়েছে এই “তারুণ্যের উৎসব ২০২৫”। নতুন আঙ্গিকে বিন্যস্ত বিপিএল-এর লক্ষ্য দেশের তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং ক্রিকেটের প্রচলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ ও সমগ্র জাতিকে জাগ্রত করা। সরকারি ও বেসরকারি সকল অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এ উৎসব উদ্‌যাপিত হয়েছে। এ উৎসবকে ঘিরে আয়োজিত হয়েছে ৪৭,২৬৩ টি ইভেন্ট, যেখানে সর্বমোট ১,৫৫,৬৮,৯৮৭ তরুণ-যুব অংশগ্রহণ করেছে এই বিপুল অংশগ্রহণকারীর ৪৬ শতাংশই ছিলেন নারী, যারা তাদের সম্ভাবনার শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন নতুন দিগন্তে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতা ও নিপুণ ব্যবস্থাপনায় ২৫টি মন্ত্রণালয়, ২৩টি সংস্থা, ৫৬টি ফেডারেশন, স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কার্যনির্বাহী টিম দেশের ৮টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা ও ৪৯৫টি উপজেলায় ছড়িয়ে দিয়েছে এ তারুণ্য ও প্রাণের উচ্ছ্বাস। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সমস্ত ইউনিয়ন, প্রতিটি গ্রাম, সুবিধাবঞ্চিত ও সুবিধাপ্রাপ্ত অঞ্চল, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ২১টি নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণী, সকলের সার্বজনীন অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন – তারা কেবল অংশগ্রহণকারী নন, বরং নেতৃত্বদাতা, পরিবর্তনের অগ্রদূত।
লক্ষণীয় বিষয়, দেশব্যাপী প্রচলিত খেলাধুলার পাশাপাশি কাবাডি, দাড়িয়াবান্ধা, নৌকা বাইচ, লাঠিখেলা, সাইক্লিং, ম্যারাথনসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্যও আয়োজন করা হয়েছে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ৫৫টি ফেডারেশনের মধ্যে ৩৯টি ফেডারেশন স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে, যেখানে ২৯,৬০৯ জন ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করেন, যার ৭,৯৩২ জন নারী। উল্লেখযোগ্য আয়োজনের মধ্য ছিল,  বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কর্তৃক জাতীয় স্কুল ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট; বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক চা শ্রমিক ও পার্বত্য নারীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ, বিচ ফুটবল ও অ্যামপিউটি ফুটবল ফেস্টিভাল; আর্চারি, তায়কোয়ান্দো, কাবাডি, অ্যাথলেটিকস, সুইমিং, হ্যান্ডবল ও দাবা ফেডারেশন কর্তৃক জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং সাইক্লিং ফেডারেশন কর্তৃক ঢাকায় বাইসাইকেল র‌্যালি ইত্যাদি। তাছাড়া যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ক্রীড়া পরিদপ্তর কর্তৃক জাতীয় গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট অনূর্ধ্ব ১৭ বালক-বালিকা ক্যাটাগরিতে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের আয়োজন। এছাড়াও, বিভিন্ন জেলায় আন্তঃকলেজ ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কাবাডি, সাঁতার, দাবা ইত্যাদি ক্রীড়া ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। মোট ১,০১৫টি ইভেন্টে ৪৩,৫৬৭ জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করেছে, যাদের মধ্যে ১৪,২৪৪ জন বালিকা এবং ২৯,৪৯৫ জন বালক। সার্বিকভাবে এই আয়োজন তারুণ্যের শক্তিকে বিকশিত করার এক অনন্য উদ্যোগ, যেখানে ক্রীড়াপ্রেমী স্বদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
খেলাধুলা সমাজে ঐক্য, সম্প্রীতির মেলবন্ধন সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন দপ্তরসমূহ ক্রীড়াঙ্গনের সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতেও খেলাধুলা সহায়ক ভূমিকা রাখছে এবং আন্তঃদেশীয় সুসম্পর্কের সেতুবন্ধন আরও দৃঢ় করবে বলে আশা ব্যক্ত করছি।

আরও পড়ুনঃ  টেকসই উন্নয়নে নারী শিক্ষা

লেখক: মো. নূর আলম
বিসিএস-তথ্য (সাধারণ), জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত
পিআইডি ফিচার

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *