গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা ও প্রত্যাশা

গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা ও প্রত্যাশা

প্রতিবিম্ব সৃষ্টিতে দর্পণের ভূমিকা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে গণমাধ্যমের ভূমিকা কি দর্পণের মতো নিরপেক্ষ? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণাও ইতিবাচক নয়। তবে গণমানুষ গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী ভূমিকা প্রত্যাশা করে।

গণমাধ্যম গণমানুষের কথা বলবে; আবার এই গণমানুষের কাছেই গণমাধ্যম দায়বদ্ধ থাকবে। এটি প্রত্যাশিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সবসময় ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং ক্ষমতাসীনদের নিকট দায়বদ্ধ ছিল। অন্যদিকে যেসব গণমাধ্যম স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে, তারা বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতির কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও গণমাধ্যমের একটি অংশ জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এর ফলে বেশকিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার আক্রমণের শিকারও হয়েছে। 

বাংলাদেশের গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা যে ইতিবাচক নয়, সেটা সহজে অনুমান করা যায়। গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের প্রকৃত ধারণা কী, তা জানার জন্য গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন জাতীয় পর্যায়ে একটি জনমত জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এই জরিপ ছিল গণমাধ্যম-সংক্রান্ত প্রথম জাতীয় সমীক্ষা। এ বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে সাতই জানুয়ারি দেশের ৬৪ জেলায় ৪৫ হাজার খানা (হাউজহোল্ড) থেকে ১০ বছরের বেশি বয়সের সদস্য থেকে মতামত সংগ্রহ করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ২৩ হাজার ১৪৫ জন নারী এবং ২১ হাজার ৯০০ জন পুরুষ। এই জরিপের মাধ্যমে গণমাধ্যমের বিস্তার, সংবাদ গ্রহণে মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন, গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৭৯.৪৬ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন, ৭১.৫০ শতাংশ মানুষ সরকারি হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন এবং ৫০.১৪ শতাংশ মানুষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। ৩১.৩৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ এই হস্তক্ষেপের জন্য দায়ী। ২৪.১৭ শতাংশ মানুষ মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং ১২.৪৫ শতাংশ মানুষ বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপকে গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ২.৮০ শতাংশ উত্তরদাতা হস্তক্ষেপের কারণ জানেন না। ১.৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা কারণ বলতে চাননি।

আরও পড়ুনঃ  সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সক্রিয় ক্রীড়াঙ্গন

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৮ শতাংশ মনে করেন, দেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়। তাঁদের মধ্যে ১৫.৩১ শতাংশ মনে করেন, গণমাধ্যম একেবারেই স্বাধীন নয় এবং ২৩.৬৪ শতাংশ মনে করেন, গণমাধ্যম কিছুটা বা কদাচিৎ স্বাধীন। ২৪.১৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, গণমাধ্যম অনেকটাই স্বাধীন এবং ১৭.২৯ শতাংশ মনে করেন, এটি পুরোপুরি স্বাধীন।

জরিপে গণমাধ্যম সম্পর্কে মানুষের প্রত্যাশার কথাও উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭.৬৭ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমকে স্বাধীন দেখতে চান। ৫৯.৯৪ শতাংশ মানুষ নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন গণমাধ্যমের প্রত্যাশা করেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গণমাধ্যমকে বিভিন্ন প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার কথা বলেছেন। ৩২.৬৮ শতাংশ মানুষ চান, গণমাধ্যম সরকারি প্রভাবমুক্ত হোক।  ৩৭.৩৯ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার কথা বলেছেন। ব্যবসায়িক প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম চান ৯.৩১ শতাংশ মানুষ এবং আর্থিক প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম চান ৯.৫৮ শতাংশ মানুষ। 

জরিপে সংবাদ গ্রহণে মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তনের বিষয়টিও উঠে এসেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মুদ্রিত সংবাদপত্রের পরিবর্তে মোবাইলে অনলাইন সংস্করণ পড়ার দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা মুদ্রিত সংবাদপত্র পড়েন না। এছাড়া ৪৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী খবরের কাগজ পড়ার প্রয়োজন মনে করেন না। জরিপে দেখা যায়, ৫৯ শতাংশ মানুষ মোবাইল ফোনে অনলাইন সংবাদপত্র পড়েন। ২.৫ শতাংশ মানুষ কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা ট্যাবে অনলাইন সংবাদপত্র পড়েন। সামগ্রিকভাবে, ৮৮ শতাংশ মানুষ গণমাধ্যমের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ৩১ শতাংশ মানুষ খবরের জন্য ফেসবুক এবং ১৬.৫ শতাংশ ইউটিউবের ওপর নির্ভরশীল। 

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৫ শতাংশ মানুষ টেলিভিশন দেখেন। জাতীয় দুর্যোগ বা সংকটে তথ্য সংগ্রহের জন্য এখনো টেলিভিশন প্রধান মাধ্যম। তবে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম হিসাবে রেডিওর ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৯৪ শতাংশ মানুষ রেডিও শোনেন না। তাদের ৫৪ শতাংশ বলেছেন, তারা রেডিও শোনার প্রয়োজন মনে করেন না। ৩৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী রেডিও সেটের অপ্রাপ্যতার কথা উল্লেখ করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  টেকসই উন্নয়নে নারী শিক্ষা

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার সম্পর্কে মানুষের ধারণা মোটেও ইতিবাচক নয়। এই দুই গণমাধ্যম ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিটিভির এক সাবেক মহাপরিচালক গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘‘সব সরকারই খবরের বিষয়ে একই নীতি অনুসরণ করে; তা হচ্ছে, বিটিভি শুধু সরকারের খবরই প্রচার করবে।’’ ১৯৯৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারে বিরোধী দলীয় নেতার ছবি বিটিভিতে দেখানোর কারণে তৎকালীন মহাপরিচালককে কারণ দর্শাতে হয়েছিল। বাংলাদেশ বেতারেরও একই অবস্থা। একটি ঘটনা বর্ণনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। গত সরকারের আমলে বেতারে দেশাত্মবোধক গান ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ প্রচারের জন্য একজন প্রযোজককে সাময়িক বরখাস্ত এবং সাত থেকে আট জন কর্মচারীকে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। বেতারের রূপকল্পে বলা হয়েছে, ‘‘সরকারের নীতি, কার্যক্রম ও উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে শ্রোতাদের অবহিত করা ও জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে তাঁদের উন্নয়ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।’’ এই রূপকল্পে বেতারকে কার্যত সরকারি প্রচারযন্ত্র হিসাবে গণ্য করার মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। 

বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে সংবাদমূল্যের চেয়ে প্রটোকলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিরোধী দলের ও বিরোধী মতের কোনো সংবাদ ও অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় না। যে গণমাধ্যমে ভিন্ন মতের প্রতিফলন থাকবে না, সেই গণমাধ্যম সম্পর্কে গণমানুষের ধারণা নেতিবাচক হবে, এটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্রীয় এই দুই গণমাধ্যম সম্পর্কে  গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বেতার ও টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিভিন্ন আন্দোলনে বারবার উচ্চারিত হয়েছে; যা প্রমাণ করে, সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত টেলিভিশন ও রেডিও আমাদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা।’’ সংগত কারণেই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সুপারিশ করেছে। এর আগে ১৯৯৭ সালে সাবেক সচিব মোহাম্মদ আসাফ্‌উদ্দৌলাহ্‌র নেতৃত্বাধীন ‘বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন স্বায়ত্তশাসন নীতিমালা প্রণয়ন কমিশন’ বিটিভি ও বেতারকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সুপারিশ করে। যদিও তা আলোর মুখ দেখেনি। ওই কমিশনের জনমত জরিপেও বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার সম্পর্কে মানুষের মতামত উঠে আসে। কমিশনের জনমত জরিপে ৩ হাজার ৪৬ জন অংশ নেন। জরিপে উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৩.৩ শতাংশ মনে করেন, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া উচিত। ৫০.৬ শতাংশ উত্তরদাতার মতে বেতার ও টেলিভিশনের জন্য পৃথক পৃথক স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষ থাকা দরকার। 

আরও পড়ুনঃ  সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক সক্রিয় ক্রীড়াঙ্গন

উত্তরদাতাদের ৫৩.১ শতাংশ বাংলাদেশ টেলিভিশনের বর্তমান মানে সন্তুষ্ট নন। উত্তরদাতাদের ৬৩ শতাংশ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও ৫৬.৮ শতাংশ বাংলাদেশ বেতারের প্রচারিত সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতায় অসন্তুষ্ট। গত ২৮ বছরে জনগণের এই অসন্তুষ্টির মাত্রা অনেক বেড়েছে।

তবে আশার কথা হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিটিভি ও বেতারে ভিন্ন মতের প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের ওপর সরকারের কোনো চাপ নেই।

গণমানুষ বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল অবস্থায় দেখতে চায়। গণমানুষের এই চাওয়াকে বিবেচনা করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং কমিশন ইতোমধ্যে সরকারের নিকট প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। গণমানুষের প্রত্যাশা, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণমাধ্যম শক্তিশালী হবে এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে ভূমিকা রাখবে।

লেখক : মো. মামুন অর রশিদ
বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
পিআইডি ফিচার

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *