হিন্দু মন্দির বোর্ডে মুসলিমদের রাখবেন?

হিন্দু মন্দির বোর্ডে মুসলিমদের রাখবেন?

অনলাইন ডেস্ক : ভারতে সদ্য পাস হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দায়ের করা অনেক মামলার একত্রিত শুনানিতে ভারতের শীর্ষ আদালত কেন্দ্রের উদ্দেশে একাধিক ‘অস্বস্তিকর’ ও ‘কঠিন’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে নতুন আইনে সেন্ট্রাল ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিমদের সদস্য করার যে বিধান রাখা হয়েছে, সেই পটভূমিতে সুপ্রিম কোর্ট বুধবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, হিন্দু এনডাওমেন্ট বোর্ডে (মন্দির বা দেবোত্তর সম্পত্তির পরিচালনা করে যারা) মুসলিম সদস্যদের রাখা হবে কি না?

পাশাপাশি ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে ধরনের সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, সেটাও ‘বিচলিত করার মতো’ বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রধান বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে মোট ৭৩টি পিটিশনকে একত্র করে করা শুনানিতে এই মন্তব্য করেন। এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি পিভি সঞ্জয় কুমার ও বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথান।

আজকের শুনানিতে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বা বহুকাল ধরে ব্যবহারের দ্বারা মসজিদ বা কবরস্থানের মতো যে সম্পত্তি ওয়াকফ বলে চিহ্নিত, সরকার কীভাবে তার দখল নিতে পারে সে ব্যাপারেও সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিনের শুনানির শেষে জানিয়েছেন, তারা একটি অন্তর্বর্তী রায় দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন; যেখানে কয়েকটি বিষয় নিয়ে তারা মতামত দেবেন।

প্রথমত, যেসব সম্পত্তিকে আদালত ওয়াকফ বলে ঘোষণা করেছেন, সেগুলোকে ‘ডিনোটিফাই’ করা যাবে কি না, কিংবা ‘নন-ওয়াকফ’ হিসেবে ঘোষণা করা যাবে কি না। আর এটা ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বা সেরকম নয়, দু’ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

আরও পড়ুনঃ  ভারতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো ৫০ বছরের পুরোনো মসজিদ

দ্বিতীয়ত, কালেক্টর (জেলা শাসক) এই ধরনের মামলায় তার তদন্ত বা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করা যাবে কি না। তৃতীয়ত, ওয়াকফ বোর্ড ও কাউন্সিলগুলোতে ‘এক্স অফিশিও’ (পদাধিকারবলে) যারা নিযুক্ত হন তাদের কথা আলাদা (যেমন এমপি, এমএলএ, জেলাশাসক প্রভৃতি); কিন্তু বাদবাকি সদস্যদের মুসলিম হতেই হবে কি না।

তবে সুপ্রিম কোর্ট এগুলোর বিষয়ে এখনও কোনো রায় ঘোষণা করেননি। এই মামলার শুনানি আগামীকালও চলবে। শুনানিতে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের রাখার প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও দেশটির সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার কাছে আদালত সরাসরি জবাবদিহি তলব করেন।

বিচারপতিরা তার কাছে জানতে চান, ‘‘মেহতা, আপনি কি বলতে চাইছেন এখন থেকে হিন্দু এনডাওমেন্ট বোর্ডেও আপনারা মুসলিমদের অ্যালাও করবেন? খোলাখুলি বলুন!’’

জবাবে সলিসিটর জেনারেল বলেন, তিনি হলফনামা দিয়ে এটাই বলতে পারেন যে (কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের ওয়াকফ বোর্ডগুলোতে) দু’জনের বেশি অমুসলিম সদস্য কখনই থাকবেন না।

ভারতে নতুন ওয়াকফ আইন নিয়ে যে বিতর্ক
ভারতে মুসলিম ওয়াকফ সম্পত্তি কীভাবে চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে, সেই সব আইনকানুনের আমূল পরিবর্তন করে লোকসভায় একটি বিতর্কিত বিল পাস হয় গত ৩ এপ্রিল। পরদিন (৪ এপ্রিল) বিলটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অনুমোদন পায়।

এরপর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই বিলটিতে সম্মতি দেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং গেজেট প্রকাশের পর তা আইনে পরিণত হয়। বিলটি নিয়ে পার্লামেন্টে যখন তর্কবিতর্ক চলছে, তখন থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মুসলিম সংগঠন এই আইনটিকে ‘কালা কানুন’ বলে বর্ণনা করে আসছেন এবং তারা প্রবল বিক্ষোভও দেখাচ্ছেন।

আরও পড়ুনঃ  ট্রাম্পের আদেশে নাসার ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী কর্মকর্তাকে বরখাস্ত

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ওয়াকফ আইন-বিরোধী প্রতিবাদ রীতিমতো সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রূপ নেয়। গত সপ্তাহে ওই সহিংসতায় বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়েছেন।

ইতিমধ্যে এই আইনটিকে অসাংবিধানিক বলে দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আলাদা আলাদা পিটিশন দাখিল করেন একাধিক সংসদ সদস্য। কয়েকটি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠীও এই আইনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।

আবেদনকারী এমপিদের মধ্যে ছিলেন এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, কংগ্রেসের মোহাম্মদ জাভেদ, রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মনোজ ঝা প্রমুখ।

এই সব মামলারই মূল কথা ছিল একটিই, নতুন এই আইনে দেশের নাগরিক হিসেবে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে এবং ইসলামের ধর্মীয় বিষয়ে, ওয়াকফ সম্পত্তির পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করেছে।

আবেদনকারীরা আরও বলেন, ওয়াকফ আইনটিতে মুসলিম এনডাওমেন্ট বোর্ডগুলোকে (ধর্মস্থান পরিচালনা করে যারা) বেছে বেছে নিশানা করা হয়েছে এবং দেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে স্বাধীনভাবে নিজস্ব ধর্মাচরণ করার যে মৌলিক অধিকার দেয় তা লঙ্ঘিত হয়েছে।

এরকম সব মামলাকে একসঙ্গে গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্ট বুধবার শুনানির দিন ধার্য করেন।

ওয়াকফ বাই ইউজার সম্পত্তিরও দলিল চাই?
ভারতে ওয়াকফ বাই ইউজার সেই ধরনের ধর্মীয় বা দাতব্য সম্পত্তিকেই বলে যা মুসলিমরা হয়তো শত শত বছর ধরে ব্যবহার করে আসছেন, কিন্তু সেগুলোর মালিকানার কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। এগুলো মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা বা কবরস্থান; এ ধরনের অনেক কিছুই হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি: পাকিস্তানের রাস্তায় বিক্ষোভে লাখো মানুষ

এক্ষেত্রে সম্পত্তির দীর্ঘকালীন ব্যবহারকেই ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃতির ভিত্তি হিসেবে এতকাল ধরা হয়ে এসেছে। এদিন সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে আবেদনকারীদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী কপিল সিব্বাল বলেন, ইসলামের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো এই ওয়াকফ বাই ইউজার!

‘‘এখন সমস্যা হলো, যে সম্পত্তি হয়তো তিন হাজার বছর আগে ওয়াকফ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সরকার এখন সেটারও ডিড (দলিল) দাবি করছেন!’’

অপর একজন পিটিশনারের তরফে সিনিয়র আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি তখন বলেন, ভারতে যে প্রায় আট লাখের মতো ওয়াকফ সম্পত্তি আছে, তার মধ্যে চার লাখই কিন্তু ‘ওয়াকফ বাই ইউজার।’

এই পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না বলেন, ‘‘আমরা শুনেছি দিল্লি হাইকোর্ট ভবনই নাকি ওয়াকফ জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এটা বলছি না যে সব ওয়াকফ বাই ইউজারই ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্যিকার উদ্বেগের কারণ আছে।’’

অভিষেক মনু সিংভি তখন বলেন, তারা নতুন ওয়াকফ আইনের কয়েকটি বিশেষ ধারার ওপর স্থগিতাদেশ চাইছেন, পুরো আইনটি নয়।

কেন্দ্রের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা যুক্তি দেন, এই আইনটি পাস হওয়ার আগে তা নিয়ে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই সুবিশদ ও সুদীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে। একটি যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটি এই বিলটি সবিস্তারে পর্যালোচনা করেছে এবং তাদের ছাড়পত্র মেলার পরই তা সভায় পেশ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে এসব মামলা আবার আগামীকাল (১৭ এপ্রিল) শুনানির জন্য উঠবে। বিবিসি বাংলা।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *