স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহী সিটি নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মুরশিদ আলম। কিন্তু ইভিএমে তাঁর হাতপাখা প্রতীক থাকায় সেখানে ভোট পড়েছে ১৩ হাজার ৪৮৭টি। একইভাবে জাকের পার্টি এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীও ধারণার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। তিনজনে মিলে পেয়েছেন ৩৫ হাজার ৪৭২ ভোট।
অথচ রাজশাহীতে এই তিন দলেরই অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। জাতীয় পার্টির কিছু সাংগঠনিক কার্যক্রম থাকলেও ইসলামী আন্দোলন এবং জাকের পার্টির ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটিই নেই। নেতাকর্মীও নেই। তারপরও জাকের পার্টির প্রার্থী লতিফ আনোয়ার গোলাপ ফুল প্রতীকে
১১ হাজার ৭১৩ এবং জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপন পেয়েছেন ১০ হাজার ২৭২ ভোট।
অথচ ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এই একই এলাকায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী হয়ে সাইফুল ইসলাম স্বপন পেয়েছিলেন মাত্র ২০৭ ভোট। অন্য দুই মেয়রপ্রার্থী এর আগে কখনও নির্বাচনেই অংশ নেননি। নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনে এবার প্রদত্ত ভোটের সাড়ে ১২ শতাংশ না পাওয়ায় মুরশিদ আলম, সাইফুল ইসলাম স্বপন ও লতিফ আনোয়ারের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তারপরও প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগের খায়রুজ্জামান লিটনের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীর বিপক্ষে এই তিন প্রার্থী এত বেশি ভোট পেলেন কীভাবে।
মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আহসানুল হক পিন্টু বলেন, ‘মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের গ্রুপ দলীয় প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনকে নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়নি। এর বাইরে কিছু বিএনপি-জামায়াতের ভোট গিয়ে পড়েছে ওই তিন প্রার্থীর ঘরে। এর বিপরীতে অবশ্য লিটনের ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করেছেন। এতেই ভোটের অংকের ব্যবধান কয়েকগুণ বেড়েছে।’
এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছেন এক লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট। এবার শহরে এর আগে ২০০৮ সালে ৯৮ হাজার ৩৬০ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পেয়েছিলেন ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট। বুলবুল আর লিটনের ভোটের ব্যবধান ছিল ২৩ হাজার ৮১০টি।
তবে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বুলবুলের কাছেই বড় ব্যবধানে হেরে যান খায়রুজ্জামান লিটন। এই নির্বাচনে বিএনপি নেতা বুলবুল পান ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৯৬ ভোট। আর লিটন পান ৮৩ হাজার ৩৮৯ ভোট। তিনি পরাজিত হয়েছিলেন ৪৮ হাজার ৪০৭ ভোটে। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে লিটন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। আর বিএনপির বুলবুল পান ৭৭ হাজার ৭০০ ভোট। ভোটের ব্যবধান ছিল ৮৭ হাজার ৬৩২টি। এবার বিনএনপি ভোটে আসেনি। হাতপাখার চেয়ে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৮০৭ ভোট বেশি পেয়েছে নৌকা। চার নির্বাচনের তিনটিতেই জয়ী হওয়া লিটনের ভোট অনেক বেড়েছে।
এবার তৃতীয়বারের মতো তিনি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে দলীয় নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে ভোটের ফল বিশ্লেষণ করছিলেন। তারা বলছিলেন, লিটনবিরোধী অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ছোট একটি অংশের ভোট গিয়ে পড়েছে ওই তিন প্রার্থীর প্রতীকে। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারকে নিয়ে কোন্দোল নির্বাচনের দুদিন আগেও প্রকাশ্যে ছিল। ফলে তাঁর কাছের লোকজন যে লিটনকে ভোট দেবেন না এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও ধরে নিয়েছিলেন।
আজিজুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘লিটনের বাইরে তিন প্রার্থী প্রায় সমান ভোট পেয়েছেন। বিএনপি এ ভোটে না থাকায় বিএনপির একটি অংশ এমনকি আওয়ামী লীগের একটি অংশ লিটনবিরোধী এই তিন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে এসেছেন। তাঁরা তিনজনই তেমন কোনো প্রচারণা না চালালেও এমনকি ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী সরে দাঁড়ানোর পরেও ভোট পেয়েছেন।’
উন্নয়ন কর্মী আলী আসগর বলেন, রাজশাহীতে কর্মসংস্থানের খুব অভাব। এবার লিটন এটাই করে দিতে চেয়েছেন। এই প্রতিশ্রুতি নগরবাসীর পছন্দ হয়েছে বলে তারা লিটনকে ভোট দিয়েছে। লিটনের বাইরে যে ভোটগুলো পড়েছে, সেটি মূলত সরকারবিরোধী ও লিটনবিরোধী অবস্থানের কারণে। সরকারবিরোধী অবস্থানের কারণে বিএনপি-জামায়াতের একটি ছোট অংশের ভোট পড়েছে অন্য তিন প্রার্থীর প্রতীকে। কারণ, এবার আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতেরও কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। তাদের অনুসারীরা কাউন্সিলর প্রার্থীকে ভোট দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নয়, এমন মেয়র প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। ফলে জাকের পার্টি, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী আন্দোলন এই ভোট পেয়েছে।’
দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতা মোসাদ্দক হোসেন বুলবুল মেয়র হওয়ার পরেও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। শহরের উন্নয়ন হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের পরেও দেড় বছর পালিয়ে ছিলেন তিনি। ওই ৫ বছরে কিভাবে এ নগরীকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, সেটিও দেখেছেন নগরবাসী। আর গত ৫ বছরে মেয়র হিসেবে লিটন নানা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে শহরকে বদলে দিয়েছেন। তাই মানুষ উন্নয়নের পক্ষে রায় দিয়েছেন। লিটনও উন্নয়নের স্বার্থে দলমত নির্বিশেষে সবার ভোট পেয়েছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল বলেন, চার মাস ধরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছিলেন লিটন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিমিনয় ছাড়াও নানাভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই সঙ্গে গত ৫ বছরের উন্নয়নচিত্র নগরবাসীর মাঝে সাড়া ফেলেছিল। এ জন্য লিটনের নিজের একটা গ্রহণযোগ্যতা এবং ইমেজ গড়ে উঠেছে। ফলে ভোটে অংশ নেওয়া অপর তিন প্রার্থীর তুলনায় তিনি অনেক বেশি পেয়েছেন। তবে অন্যরা যে ভোট পেয়েছেন সেটাও তাদের জন্য কম না।